কেন ব্যাঙ যার বৈজ্ঞানিক নাম Rhinella marina একটি দানবীয় নিওট্রপিকালটোড বা মেরিন ব্যাঙ নামেও পরিচিত। এটি একটি বৃহৎ ,স্থলচর কুনোব্যাঙ যা দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার মূল ভূখণ্ডে পাওয়া যায়।
তবে ওশেনিয়া,ক্যারিবীয় দ্বীপ এমনকি উত্তর অস্ট্রেলিয়াতেও এটির খোঁজ পাওয়া গেছে। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম কুনোব্যাঙ। এটি Rhinella গণের একটি সদস্য হওয়া সত্ত্বেও পূর্বে এটি Bufo গণের অধীনে বিন্যস্ত ছিল যেখানে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার অনেকগুলো প্রকৃত কুনোব্যাঙ প্রজাতি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
কেন ব্যাঙ একটি উর্বর প্রজননকারী। স্ত্রী ব্যাঙ হাজার হাজার ডিমযুক্ত একটি ক্ল্যাম্প প্রসব করে। এর প্রজনন সাফল্য অনেকটা আংশিক যার কারণ হিসেবে বলা যায় এর সুযোগসন্ধানী খাদ্যাভ্যাস। এর এমন এক খাদ্যাভ্যাস রয়েছে যা কিনা অন্যান্য কুনোব্যাঙ প্রজাতির মধ্যে সচরাচর লক্ষ্য করা যায়না। এটি জীব ও জড়বস্তু সবকিছুই খেয়ে ফেলতে পারে। প্রাপ্তবয়স্ক ব্যাঙের গড় দৈর্ঘ্য ১০-১৫ সেন্টিমিটার (৩.৯-৫.৯ইঞ্চি)।
ঐতিহাসিকভাবেই কেন ব্যাঙ আখের ক্ষেত হতে কীটপতঙ্গ নির্মূলে ব্যবহৃত হত যার কারণে তারা এই 'কেন' নামে পরিচিত । কেন ব্যাঙের আরও অনেক সাধারণ নাম রয়েছে যেমন দানবীয় কুনোব্যাঙ, মেরিন কুনোব্যাঙ। পূর্বের নামটি তার আকারকে ইঙ্গিত করে আর পরের নামটি এসেছে তার দ্বিপদী নামকরণ R.marina হতে। এটি লিনিয়াস কর্তৃক রচিত সিস্টেমা ন্যাচুরা(১৭৫৮ সাল)[৫] বর্ণিত বহু প্রজাতির মধ্যে অন্যতম ছিল। লিনিয়াস ডাচ বিজ্ঞানী আলবার্টস সেবার একটি বিবরণের ওপর ভিত্তি করে একটি উপাধি দাঁড় করিয়েছিলেন, যিনি ভুলবশত বিশ্বাস করতেন যে কেন ব্যাঙ সমুদ্রে ও স্থলে উভয় জায়গাতেই বিচরণ করত।[৬] অন্যান্য সাধারণ নামগুলোর মধ্যে রয়েছে দানবীয় কুনোব্যাঙ ,দানবীয় নিওট্রপিকাল কুনোব্যাঙ,ডমিনিকান কুনোব্যাঙ, দানবীয় সামুদ্রিক কুনোব্যাঙ[৯] এবং দক্ষিণ আমেরিকান কেন ব্যাঙ। ত্রিনিদাদীয় ইংরেজিতে এগুলোকে বলা হয় "ক্রাপড" যা কুনোব্যাঙের ফরাসি নাম।
Rhinella গণটিকে এটির নিজস্ব স্বতন্ত্র গণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় বলে এটি তার বৈজ্ঞানিক নামকে পরিবর্তন করে। এক্ষেত্রে আইসিজিএন ঘোষিত লৈঙ্গিক শর্তের সঙ্গে একমত হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট মেরিনাস (পুং) নামটি মেরিনা(স্ত্রী) তে রূপান্তরিত করা হয়। এতে দ্বিপদী নামটি Bufo marinus থেকে Rhinella marina তে পরিবর্তন করা হয়। দ্বিপদী নাম Rhinella marinus পরবর্তীকালে প্রমুক,রবার্টসন, সাইটস এবং নুনান(২০০৮ সাল) কর্তৃক ভুল বানান দ্বারা পরিচিতি পায়। বিতর্কিত থাকা সত্বেও (যদিও অনেক বুনিয়াদি সরীসৃপবিদ এখনো Bufo marinus নামটি ব্যবহার করেন) দ্বিপদী নামটি আইইউসিএন, এনসাইক্লোপিডিয়া অব লাইফ, অ্যাম্ফিবিয়ান স্পিসিস অব দ্য ওয়ার্ল্ড এবং ক্রমবর্ধমান বৈজ্ঞানিক প্রকাশনীর মত প্রতিষ্ঠান দ্বারা ব্যবহারের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে আসছে।
কেন ব্যাঙ অনেক বড় আকৃতির হয়ে থাকে । পুরুষদের চেয়ে স্ত্রী আবার বেশ দীর্ঘ হয়ে থাকে এবং সাধারণত ১০-১৫ সেন্টিমিটার (৩.৯-৫.৯ইঞ্চি) হতে সর্বোচ্চ ২৪ সেন্টিমিটার(৯.৪ ইঞ্চি) পর্যন্ত দীর্ঘ হয় । কম ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত বড় ব্যাঙগুলোর দেখা মেলে। বুনো পরিবেশে তাদের আয়ু ১০-১৫ বছর হতে পারে এবং সংরক্ষিত অবস্থায় এরা আরও বেশ কয়েক বছর বাঁচতে সক্ষম। একটি নমুনায় প্ররমাণ মেলে যে একটি ব্যাঙ প্রায় ৩৫ বছর বেঁচে ছিল।
কেন ব্যাঙের ত্বক শুষ্ক এবং আঁচিলযুক্ত হয়ে থাকে। এর চোখের উপর বিশেষধরনের খাঁজ রয়েছে যা নাসারন্ধ্র পর্যন্ত বিস্তৃত। কেন ব্যাঙ বিভিন্ন বরনের হয়ে থাকে যেমন ধূসর,হলুদাভ,বাদামী-লাল অথবা বাদামী-জলপাই বর্ণের ইত্যাদি। প্রত্যেক চোখের পেছনে একটি করে বড় প্যারোটিড গ্রন্থি রয়েছে । উদরীয় পৃষ্ঠটি ক্রিম বর্ণের এবং এতে কালো-বাদামী ফুস্কুড়িও থাকতে পারে। এদের চোখের তারাগুলো আনুভূমিক এবং আইরিজের বর্ণ সোনালী। পায়ের আঙ্গুলগুলোর গোড়ায় মাংসল সংযোগ রয়েছে,তবে আঙ্গুলগুলো সংযোগমুক্ত।
সাধারণত তরুণ কেন ব্যাঙের মসৃণ ও কালো চামড়া দেখা যায় যদিও কিছু নমুনায় লালচে বর্ণের হয়ে থাকে। তরুণ ব্যাঙগুলোতে বড়দের মত বৃহৎ প্যারোটিড গ্রন্থি থাকেনা যে কারণে এরা অপেক্ষাকৃত কম বিষাক্ত হয়ে থাকে। ব্যাঙ্গাচিগুলো ছোট ও সুষম কালো বর্ণের হয়ে থাকে এবং এরা জলাশয়ের তলানিতে ঝাঁক বেঁধে বাস করে। ব্যাঙ্গাচিগুলো দৈর্ঘ্যে ১০-১৫ মিমি(০.৩৯-০.৯৮ ইঞ্চি) পর্যন্ত হয়ে থাকে।
কৃষিজমির কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে কেন ব্যাঙকে বিশ্বের নানা অঞ্চলের সাথে বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সাথে পরিচয় করানো হয়েছিল। অঞ্চলগুলোর সাথে কেন ব্যাঙের প্রবর্তনের কথা বেশ ভালভাবেই নথিভুক্ত করা হয়ে আসছিল এবং এর মধ্যে কেন ব্যাঙ হতে পারে সবচেয়ে অধ্যয়ন করা প্রজাতিগুলোর মধ্যে অন্যতম।
১৮৪০ দশকের শুরুতে ফরাসি গায়ানা এবং গিয়ানা থেকে মার্টিনিক এবং বার্বাডোসে কেন ব্যাঙকে পরিচয় করানো হয়েছিল। ইঁদুরের বংশবিস্তার রোধে ১৮৪৪ সালে জ্যামাইকাতে কেন ব্যাঙকে নিয়ে আসা হয়েছিল।
ইঁদুর নিয়ন্ত্রণে ব্যার্থ হওয়া সত্বেও বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে পুয়ের্তোরিকোতে আখের আবাদে বিটল পোকার আক্রমণের বিপর্যয় ঠেকাতে কেন ব্যাঙ নিয়ে আশা হয়। পুয়ের্তোরিকান প্রকল্পটি সফল হয়েছিল এবং বিটল পোকা সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি রোধ করেছিল। আর এ ঘটনাই পরে ১৯৩০ এর দশকে বিজ্ঞানীদের কৃষি জমির কীট দমনে আদর্শ সমাধান হিসেবে ব্যবহার করতে উৎসাহ যুগিয়েছিল। এর ফলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পুয়ের্তোরিকোতে ব্যবহৃত পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল এবং ১৯৩০ এর দশকে এই কুনোব্যাঙটি আরও অনেক দেশের সাথে পরিচিতি অর্জন করেছিল। যে সব অঞ্চলে ব্যাঙটিকে পরিচয় করানো হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল অস্ট্রেলিয়া, ফ্লোরিডা, পাপুয়া নিউগিনি,ফিলিপাইন,জাপানের ওগাসাওয়ারা, ইশিগাকি দ্বীপ এবং ডাইসে দ্বীপপুঞ্জ ,ক্যারিবীয় দ্বিপের অধিকাংশ, ফিজি ও হাওয়াই সহ অন্যান্য অনেক প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ। আর তখন থেকেই কেন ব্যাঙ এর অনেক আশ্রয়দাতা দেশগুলোতে বালাই হিসেবে পরিগণিত হয় এবং তা এলাকার স্থানীয় প্রাণীদের জন্য এক মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
পোকামাকড়ের জৈবিক নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ব্যবহার ছাড়াও কেন ব্যাঙ বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক প্রয়োগে ব্যবহৃত হয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে দক্ষিণ আমেরিকায় ব্যাঙগুলোর প্রাকৃতিক আবাসস্থলসমূহের পরিসীমার মধ্যে এম্বেরা-ওউনান উপজাতিরা ব্যাঙগুলোর বিষ আহরণের জন্য তাদের দুধ খেতে দিত। এ বিষ তারা তীরের ফলায় লাগাত। বিষগুলো ওলমেক আদিবাসীরা এন্থিওজেন হিসেবে ব্যবহার করে থাকত। পেরুর কিছু অঞ্চলে ব্যাঙটিকে খাদদের উৎস হিসেবে শিকার করা হত এবং সাবধানে চামড়া ও প্যারোটিড গ্রন্থি অপসারণের পর তা ভক্ষণ করা হত। ভালভাবে প্রস্তুত করার পর ব্যাঙের মাংস উপাদেয় খাদ্য এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। খুব সম্প্রতি ব্যাঙটির বিষ বেশ কয়েকটি নতুন উপায়ে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। জাপানে বুফোটক্সিনকে যৌন উত্তেজক এবং চুল পুনরুদ্ধারকারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। চীনে এটি হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের হৃদযন্ত্রের অপারেশনের সময় হৃদকম্পন স্তিমিত করার কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। নতুন গবেষণা বলে কেন ব্যাঙের বিষ প্রোস্টেট ক্যান্সারের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যেতে পারে। হাইতিতে স্থানীয় এ ব্যাঙের বিষটি ধুতুরা ও পাফারফিশ এর বিষের সংমিশ্রণে "জম্বি বিষ" তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছিল যার উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯৮৫ সালে ওয়েড ডেভিস রচিত "দ্য সার্পেন্ট অ্যান্ড দ্য রেইনবো" নামক বইটিতে।
কেন ব্যাঙের অন্যান্য আধুনিক ব্যবহারগুলোর মধ্যে গর্ভাবস্থা পরীক্ষা করা, পোষা প্রাণী হিসেবে ব্যবহার এবং চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন করা উল্লেখযোগ্য। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে মহিলার প্রস্রাব কেন ব্যাঙের লসিকা থলিতে ইঞ্জেকশানের মাধ্যমে প্রবেশ করানো হত এবং ব্যাঙের প্রস্রাবে শুক্রাণুর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলে মহিলাটিকে গর্ভবতী বলে মনে করা হত। অন্যান্য স্তন্যপায়ীদের তুলনায় ব্যাঙ ব্যবহার করে এ পরীক্ষাটির ফলাফল বেশ দ্রুত পাওয়া গিয়েছিল। আবার ব্যাঙগুলোকে লালনপালন করাও অনেক সহজ ছিল। সেগুলো সংখ্যায়ও প্রচুর ছিল। তাছাড়া ব্যাঙগুলোর দেখভাল,যত্ন করতেও খরচ হতনা বললেই চলে। এসব পরীক্ষায় কেন ব্যাঙের ব্যবহার ১৯৫০ এর দশকে শুরু হয়েছিল এবং ১৯৬০ এর দশকের শেষ দিকে বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রফতানির উদ্দেশ্যে বিপুল সংখ্যক ব্যাঙ সংগ্রহ করা হয়েছিল। তখন থেকেই অনেক অস্ট্রেলীয় রাজ্য আমদানি বিধি প্রবর্তন করেছিল কিংবা কোন ক্ষেত্রে তা কঠোরও করেছিল।
এমনকি মৃত ব্যাঙেরও মূল্য রয়েছে। কেন ব্যাঙের চামড়া হতে অভিনব চামড়াজাত দ্রব্যাদি তৈরি হয়ে আসছে। স্টাফকৃত কেন ব্যাঙগুলো বিভিন্ন ভঙ্গিমায় রেখে আনুষঙ্গিক উপকরণ দ্বারা সাজিয়ে রাখা হয়। যার ফলে এটি পর্যটন বাজারে বেশ কদর পেয়েছে। তাছাড়া এর দেহ থেকে সার উৎপাদনের প্রচেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে।