ভয় পেলে কিংবা কোণঠাসা হলে ইঁদুর কামড়ে দিতে পারে। এটি ঘটতে পারে যখন আপনি কোনো ইদুরের খাঁচায় হাত ঢুকিয়ে দেন অথবা পরিবেশে ইঁদুরের যদি বেড়ে যায়।
ইঁদুরের কামড় বিভিন্ন উপায়ে মানুষের ক্ষতি করতে পারে। সবচেয়ে তাৎক্ষণিক এবং সুস্পষ্ট বিপদ হল সংক্রমণের ঝুঁকি। ইঁদুর তাদের লালায় বিভিন্ন ধরণের ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং অন্যান্য রোগজীবাণু বহন করতে পারে এবং যখন তারা কামড় দেয় তখন তারা এই রোগজীবাণুগুলিকে মানুষের কাছে স্থানান্তর করতে পারে। ইঁদুরের কামড়ের মাধ্যমে যে রোগগুলি ছড়াতে পারে তার মধ্যে রয়েছে ইঁদুর-কামড়ের জ্বর, হান্টাভাইরাস, লেপ্টোস্পাইরোসিস এবং সালমোনেলোসিস।
ইঁদুরের কামড় একটি অতি সাধারণ ঘটনা। আমাদের আশেপাশেই নিত্য নৈমিত্তিক ঘটে থাকে। কিন্তু এর প্রতিকার সম্পর্কে সচেতনতা সচরাচর দেখা যায়না। কারণ মানুষ ইঁদুরের কামড়ের মত ঘটনাকে অনেকটা হালকা ভাবেই গ্রহণ করে। কিন্তু ইঁদুরের কামড় মোটেও অবহেলা করার মত বিষয় নয়। সময়মত সুচিকিৎসা না পেলে ঘটতে পারে অনেক বিপদ আপদ।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশের মানুষের ইঁদুর পালার শখ না থাকলেও এদেশের ঘরে ঘরে রয়েছে ইঁদুর। রান্নাঘর থেকে শুরু করে বাথরুম, বেডরুম, বাগান সব জায়গায় রয়েছে এদের অবাধ বিচরণ। এরা খুব দ্রুত বংশ বিস্তার করে এবং ঘরের জিনিসপত্র ও বই-খাতা কেটে কুটে একাকার করে দেয়। যদিও এরা মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলে তারপরেও এরা যদি কোনো কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়ে কিংবা বাচ্চাদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে এরা মানুষকে কামড় দিয়ে থাকে।
ইঁদুরের কামড় সবসময় মারাত্মক নাও হতে পারে। তবে ক্ষতস্থান থেকে ইনফেকশন ঘটতে পারে কিংবা র্যাট ফিভার নামক ইঁদুরের কামড় জনিত এক প্রকার জ্বর হতে পারে।
ইঁদুরের কামড় সম্পর্কে জানতে আরোও পড়ুন। কিভাবে ইঁদুরের কামড় শনাক্ত করবেন এবং কখন ডাক্তার দেখাবেন তা নিচে আলোচিত হলঃ
ইঁদুরের কামড় দেখতে কিরকম হয়?
একটি ইঁদুরের কামড় দিলে একটি ছোট ক্ষত বা ত্বকে একটি ক্ষত হিসাবে প্রদর্শিত হতে পারে। ইঁদুরের আকার এবং কামড়ের শক্তির উপর নির্ভর করে কামড়ের আকার এবং চেহারা পরিবর্তিত হতে পারে। ক্ষতস্থান থেকে রক্তপাতও হতে পারে এবং আশেপাশের জায়গা ফুলে ও লাল হয়ে যেতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, একাধিক কামড় হতে পারে, কারণ ইঁদুর পরপর কয়েকবার কামড়ায় বলে জানা যায়।
এটি লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ যে ইঁদুরের কামড়কে অন্যান্য ধরণের প্রাণীর কামড় থেকে আলাদা করা কঠিন হতে পারে, যেমন ইঁদুর বা কাঠবিড়ালির কামড় থেকে। আপনি যদি সন্দেহ করেন যে আপনাকে ইঁদুর বা অন্য কোন প্রাণী কামড়েছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তারের কাছে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। একজন স্বাস্থ্যসেবা পেশাদার ক্ষতটি মূল্যায়ন করতে পারেন, এটি সঠিকভাবে পরিষ্কার করতে পারেন এবং সংক্রমণ বা অন্যান্য জটিলতা প্রতিরোধের জন্য আরও চিকিত্সা প্রয়োজন কিনা তা নির্ধারণ করতে পারেন।
ইঁদুর কামড় দিলে ক্ষতস্থানে সাধারণত দুটি ক্ষুদ্র সূচের ছিদ্রের ন্যায় দাঁতের দাগ দেখতে পাওয়া যায়। দাঁতের দাগ এক বা একাধিকও হতে পারে। ক্ষতস্থান থেকে রক্তও ঝড়তে পারে। ক্ষতস্থানটি ফুলে জেতে পারে, ব্যাথা করতে পারে এমনকি অবস্থা বেশি খারাপ হলে ইনফেকশন হয়ে পুঁজ জমে যেতে পারে।
কিভাবে নিশ্চিত হবেন যে আপনার র্যাট বাইট ফিভার হয়েছে?
নাম শুনেই ধারণা করা যায় এই র্যাট বাইট ফিভার নামক জ্বর আসে ইঁদুরের কামড় হতে। তবে শুধু ইঁদুরের কামড় থেকেই নয়, এ র্যাট ফিভার হতে পারে কাঠবিড়ালি, বেজি কিংবা বিড়ালের কামড় থেকেও।
অনেক ক্ষেত্রেই ইঁদুরের কামড় থেকে সৃষ্ট র্যাট বাইট ফিভারের ফলে শরীরে র্যাশ উঠে। র্যাশগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফুসকুড়ির ন্যায় হয়ে থাকে। এগুলো লালচে কিংবা বেগুনী বর্ণ ধারণ করে। অনেক সময় ফোস্কাও পড়ে যায়।
মূলত দুই ধরনের র্যাট বাইট ফিভার দেখা যায়। আর এগুলো ঘটে দুটি ভিন্ন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার কারণে। স্ট্রেপ্টোব্যাকিলারি র্যাট বাইট ফিভার এদের মধ্যে আমেরিকায় সচরাচর বেশি দেখা যায়। অপরদিকে বাংলাদেশ, ভারত সহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে স্পাইলারি র্যাট বাইট ফিভার বেশি দেখা যায়। এটি সোডোকু নামেও পরিচিত।
স্ট্রেপ্টোব্যাকিলারি র্যাট বাইট ফিভারের লক্ষণসমূহঃ
স্ট্রেপ্টোব্যাকিলারি র্যাট বাইট ফিভারের উপশম তুলনামূলকভাবে দ্রুতই হয়ে থাকে। তবে কিছু ক্ষেত্রে এ রোগ হলে ৩ থেকে ১০ দিনের ভেতরে নিচের উপসর্গসমূহ দেখা যায়ঃ
- জয়েন্টে (অস্থি সন্ধিতে) ব্যাথা
- জ্বর ও গা শিরশির অনুভূতি
- মাংসপেশিতে ব্যাথা
- মাথাব্যাথা
- র্যাশ ওঠা
- বমি ও ডায়রিয়া
স্পাইলিয়ারি র্যাট বাইট ফিভারের লক্ষণসমূহঃ
ইঁদুরের কামড়ের ফলে সৃষ্ট স্পাইলিয়ারি র্যাট বাইট ফিভার আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে দ্রুত সেরে উঠবে। কিন্তু এটি আরো বেশি সময় স্থায়ী হয়ে থাকে। যাইহোক, নিচের লক্ষণসমূহ এক সপ্তাহ থেকে শুরু করে তিন সপ্তাহের মধ্যে দেখা দিতে পারেঃ
- মাথাব্যাথা
- জ্বর ও গা শিরশির ভাব
- মাংশপেশিতে ব্যাথা
- গলা ব্যাথা করা
- বমি
- লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া
- ক্ষতস্থানে পচন ধরা
- চামড়ায় র্যাশ ওঠা
ইঁদুর কামড়ালে কিভাবে চিকিৎসা নিবেন?
ইঁদুর কামড়ালে দেরি না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্ষতস্থানটি গরম পানি ও সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। এরপর পরিষ্কার শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে সেখানে মলম লাগিয়ে নিন। হাতের কাছে ব্যান্ডেজ থাকলে তা লাগিয়ে দিন।
ক্ষতস্থানটি যতই ছোট মনে হোক না কেন, যত দ্রুত সম্ভব চিকিতসকের শরণাপন্ন হোন। কারণ ইঁদুরের কামড় হতে ভয়াবহ ইনফেকশন হতে পারে। ইঁদুর কামড়ালে টিটেনাস এর টিকা নিতে হবে। বিশেষকরে যদি পূর্বেই টিটেনাসের টিকা নিয়ে থাকেন তাহলে দেখবেন যে সেটা গ্রহণের পর পাঁচ বছর অতিক্রম হয়েছে কিনা। যদি ইঁদুর কামড়ায় আর আপনার টিটেনাসের ডোজ নেয়ার পাঁচ বছর অতিক্রম হয় তাহলে পুনরায় আপনাকে টিটেনাসের টিকা দিতে হবে।
কিছ ক্ষেত্রে ডাক্তাররা সংক্রমণ এড়াতে এন্টিবায়োটিক ঔষধ সেবনের পরামর্শও দিয়ে থাকতে পারেন।
ক্ষতস্থান সেরে উঠতে শুরু করলে আপনাকে র্যাট বাইট ফিভারের লক্ষণের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। যেমনঃ
- ত্বক স্পর্শ করলেই গরম অনুভূত হবে
- ত্বকের বিভিন্ন স্থান লাল হয়ে যাবে ও ফোস্কা উঠবে
- পুঁজ নিঃসৃত হবে
- বুক ধড়ফড় করবে
- জ্বর আসবে
- হাড়ের জয়েন্টে ব্যাথা করবে
র্যাট বাইট ফিভারের চিকিৎসা
আপনার যদি র্যাট বাইট ফিভার কিংবা কোনো ইনফেকশন হয় তাহলে আপনার এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করতে হবে। আপনাকে প্রায় ৭ থেকে ১০ দিন ধরে এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করতে হতে পারে। গুরুতর কামড়ের জন্য আপনাকে শিরায় এন্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন দিতে হতে পারে।
এন্টিবায়োটিক গ্রহণের ক্ষেত্রে অবশ্যই আপনাকে পুরো কোর্স শেষ করতে হবে। তা না হলে সব জীবাণু ধ্বংস হবে না আর এন্টিবায়োটিকের প্রতি এরা রেসিস্টেন্ট হয়ে যাবে।
কি হতে পারে যদি র্যাট বাইট ফিভারের চিকিৎসা না করা হয়?
পর্যাপ্ত চিকিৎসা না করা হলে র্যাট বাইট ফিভার মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। যেমনঃ
- মায়োকার্ডিটিস
- এন্ডোকার্ডিটিস
- নিউমোনিয়া
- সিস্টেমিক ভাস্কুলিটিস
- পেরিকার্ডিটিস
- হেপাটাইটিস
- নেফ্রিটিস
- মেনিঞ্জাইটিস
- এমনিওনিটিস
এদের মধ্যে কিছু রোগের জটিলতা জীবনের হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। সুতরাং কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত।
পরিশেষে
ইঁদুর কামড়ালে অবশ্যই দ্রুত ডাক্তারের কাছে যান , কেননা পর্যাপ্ত চিকিৎসায় র্যাট বাইট ফিভার বা ইনফেকশন প্রতিকার করা যায়। যদি আপনার ইনফেকশন হয় তাহলে সপ্তাহখানেক আপনাকে এন্টিবায়োটিক সেবন করতে হতে পারে।
যদি ক্ষত গভীর হয়, প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় বা সংক্রমণের লক্ষণ দেখা যায়, অবিলম্বে চিকিৎসার পরামর্শ নিন। একজন স্বাস্থ্যসেবা পেশাদার ক্ষতটি মূল্যায়ন করতে পারেন, এটি সঠিকভাবে পরিষ্কার করতে পারেন এবং আরও চিকিত্সা যেমন অ্যান্টিবায়োটিক বা টিটেনাস শট প্রয়োজন কিনা তা নির্ধারণ করতে পারেন।
এটি লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে ইঁদুরের কামড় গুরুতর রোগ বহন করতে পারে যেমন ইঁদুর-কামড়ের জ্বর এবং লেপটোস্পাইরোসিস। আপনি যদি ইঁদুরের কামড়ের পরে জ্বর, মাথাব্যথা, পেশীতে ব্যথা বা ফুসকুড়ির মতো লক্ষণগুলি বিকাশ করেন তবে অবিলম্বে চিকিত্সার পরামর্শ নিন।
আর মনে রাখবেন এন্টিবায়োটিকের কোর্স অবশ্যই সম্পূর্ণ করতে হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপনার মৃদু জ্বর আসতে পারে, তবে যথাযথ চিকিৎসা নিলে তা ধীরে ধীরে সেরে উঠবে।