কবুতর খুবই বন্ধুসুলভ একটি পাখি আর শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষ এই পাখিটিকে পালন করে আসছে। এমনকি কবুতরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে করানো হয় অনেক জটিল কাজও, যেমন চিঠি বিলি করা। তবে কবুতররা সঙ্গ পছন্দ করে। তাই আপনি যদি কবুতর কিনবেন ভাবছেন তাহলে অবশ্যই আপনাকে সেই কবুতরটির প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী হতে হবে।
আপনার কবুতরকে প্রস্তুত করুনঃ
শুরুতেই আপনাকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে এ ব্যাপারে। কেননা, কবুতররা সামাজিক পাখি। যদি কেবলমাত্র একটি কবুতর রাখবেন বলে ভাবছেন তাহলে আপনাকে সেই কবুতরটির পেছনে যথেষ্ট সময় ও সঙ্গ দিতে হবে কবুতরটিকে খুশি রাখার জন্য।
- আপনার এলাকার আশেপাশে যারা কবুতর পালেন তাদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যে আপনি কবুতর পালনে আদৌ প্রস্তুত কিনা।
- কবুতরের রয়েছে অনেক জাত। আর তাদের সামাজিকীকরণ পদ্ধতিও বিভিন্নরকম হয়ে থাকে। তাই আপনাকে প্রতিদিন কিছু সময় বের করে নিতে হবে কবুতরকে সঙ্গ দেয়ার জন্য।
খাঁচা কিনুনঃ
কবুতর পালনের জন্য আপনাকে অবশ্যই ঘরের ভেতরে এদের থাকার বন্দোবস্ত করতে হবে। খুব ভাল হয় যদি আপনি এদের বাসস্থানটি আপনার ঘরের বাহিরে তৈরি করতে পারেন। অবশ্যই কবুতর কেনার পূর্বেই এসব কাজ শেষ করে রাখবেন। নতুন কবুতরকে সাথে সাথে ঘর না দিলে এরা সাধারণত অমনোযোগী হয়ে পড়ে। কবুতর কিনে আনার পূর্বে অবশ্যই খাঁচাটি ভালোভাবে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে নিবেন।
- ঘরের ভেতরের খাঁচার জন্য আদর্শ হল চারকোণা আয়তাকার খাঁচা। খাঁচাটির সকল পাশে বন্ধ থাকতে হবে এবং এক সাইডে ছোট দরজা থাকবে। খাঁচা কেনার সময় ভালভাবে লক্ষ করবেন যে খাঁচার ফুটো যেন এমন না হয় জাতে কবুতর মাথা গলিয়ে দিতে পারে সহজেই। কবুতর হাঁটতে পছন্দ করে তাই খাঁচার নিচের অংশ কাগজ বা ঘাস জাতীয় নরম কিছু দিয়ে ঢেকে দিতে পারলে ভাল হয়। খাঁচাটি উজ্জ্বল ও পর্যাপ্ত রোদ ও আলোবাতাস প্রবেশ করে এমন স্থানে রাখা উচিত। তবে সরাসরি সূর্যালোক থেকে দূরে রাখুন। সন্ধ্যাবেলা কিংবা রাতের বেলা যদি কোন কারণে খাঁচায় অতিরিক্ত আলো প্রবেশ করে তাহলে খাঁচাটিকে আলো হতে দূরে সরিয়ে রাখুন।
- খুব ভালো হয় যদি আপনি একটি এভিয়ারি করতে পারেন। যদিও এভিয়ারি করা একটু ব্যয়বহুল ব্যাপার। তারপরেও এভিয়ারি করলে কবুতররা খাঁচার তুলনায় অনেক স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারে। ঘরের বাহিরে এভিয়ারি করলে সেটির দৈর্ঘ্য হওয়া উচিত কমপক্ষে ফিট এবং উচ্চতা হওয়া উচিত কমপক্ষে ৬ ফিট। কবুতরের খোপ তৈরির জন্য এভিয়ারির ভেতরে রাখতে পারেন কিছু তাক। যতটা সম্ভব তাকগুলো উঁচুতে স্থাপন করা উচিত। কারণ এতে করে আপনার কবুতরগুলো শিকারই প্রাণী হতে রক্ষা পাবে। যদি সম্ভব হয় তবে আপনার এভিয়ারিটি দক্ষিণ কিংবা দক্ষিণ পশ্চিমমুখি করে তৈরি করুন। এতেকরে পর্যাপ্ত সূর্যালোক প্রবেশ করবে।
- খাঁচার ভেতরে একটি পাত্রে পরিষ্কার পানি রাখুন যাতে কবুতরগুলো পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি করে নিজেদের পরিষ্কার রাখতে পারে।
- কিছু কিছু কবুতরের জাত আছে যারা মুক্তভাবে উড়তে অভ্যস্ত। আপনি এদের জন্য খোপের বন্দোবস্ত করতে পারেন। খোপ স্থাপন করার সময় তা আপনার বাসার দেয়ালের ঠিক পাশেই লাগাবেন। তবে এক্ষেত্রে একটি ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে যে আপনার কবুতরগুলো মুক্তভাবে রাখলে বা উড়তে দিলে যেকোনো সময় শিকারি প্রাণী কিংবা শিকারি পাখিদের শিকারে পরিণত হতে পারে।
খাবার কিনুন
কবুতরর জন্য দোকানে পাওয়া যায় বিভিন্ন রকমের খাবার ও খাবারের মিশ্রণ। তবে পিলেট খাদ্য কবুতরের জন্য পুষ্টির ভালো উৎস বলা যেতে পারে। আবার বিভিন্ন প্রকার বীজের মিশ্রণ ও অন্যান্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদিত খাদ্যও এদের খাওয়ানো যেতে পারে।
- নিয়মিত খাদ্যের পাশাপাশি আপনার কবুতরকে খাওয়াতে পারেন পুঁইশাক, লেটুশ পাটা, তিল, পালং শাক, আপেলের টুকরো ইত্যাদি।
- খাবারের পাশাপাশি এদের নিয়মিত ইটের গুঁড়ো (গ্রিট) কিংবা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নুড়িপাথর খেতে দিতে পারেন। এগুলো এদের হজমে সহায়তা করে। তাছাড়া ইটের গুঁড়ো বা গ্রিটে রয়েছে প্রচর ক্যালসিয়াম যা কবুতরের ডিমের খোলস সুগঠিত করে।
- পাখির দোকানে বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন ও ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট পাওয়া যায়। এগুলো পরিমিত মাত্রায় ব্যভার করেও আপনার কবুতরের স্বাস্থ্য উন্নত রাখতে পারেন।
কবুতর খুঁজুন
অনলাইনে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলিতে আপনি লোকাল কবুতরের ব্রিডারদের সন্ধান পাবেন খুব সহজেই। কোনো কোনো জায়গায় পেতে পারেন বেওয়ারিশ ও হারিয়ে যাওয়া কবুতরের সন্ধান। নিকটবর্তি প্রাণী আশ্রয়কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে সেখান থেকে কবুতর নিয়ে আসতে পারেন। তবে যে ভাবেই আপনি কবুতর সংগ্রহ করুন না কেন অবশ্যই জেনে নিবেন যে কোন জাতের কবুতর আপনি নিচ্ছেন। কারণ বিভিন্ন জাতের কবুতরের প্রয়োজন ও আচরণ বিভিন্নরকম হয়ে থাকে।
- সাধারণত সুপারিশ করা হয় যে আপনি সেখানে গিয়ে প্রথমে কয়েকটি কবুতর বেশ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করুন। যদি দেখেন যে সেগুলোর মধ্যে এলার্জি কিংবা ফ্লু এর সংক্রমণ রয়েছে তবে তা কেনা থেকে বিরত থাকুন। আরো দেখুন যে কবুতরগুলো আপনার আশানুরুপ আচরণ করছে কি না। ভালো করে লক্ষ করুন যে কবুতরের আশ্রয়স্থল পরিষ্কার আছে কিনা। কবুতরগুলোর ঠিকমত যত্ন নেয়া হচ্ছে কিনা তাও লক্ষ রাখুন। কেননা, কবুতরগুলোর ঠিকঠাক যত্ন না নেয়া হলে পরবর্তিতে সেগুলোকে আপনি সামাজিক বানাতে পারবেন না।
কবুতরের যত্ন
শুরুতেই কবুতরকে ঘরের ভেতরে রাখুন।
যখন আপনি প্রথম কবুতর কিনবেন তখন কবুতরগুলোকে সাধারণত ঘরে রাখার পরামর্শ দেয়া হয়। কারণ এর ফলে আপনার সাথে কবুতরগুলোর সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয়। আর কোনো কবুতর যদি জোড়াবিহীন অবস্থায় কিনেন তবে আপনাকেই তাকে সঙ্গ দিতে হবে। তাই যতটা সম্ভব একাকী কবুতরের সংস্পর্শে থাকার চেষ্টা করুন।
- কখনই রান্নাঘরে কবুতর রাখবেন না। এর কারণ চুলায় বসানো উত্তপ্ত নন স্টিক ফ্রাইং প্যানের ধোঁয়া কবুতরের ওপর বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে।
আপনার কবুতরের সাথে বন্ধন তৈরি করুন
প্রথম কয়েকদিন কবুতরকে মানিয়ে নেয়ার সময় দিন। এমতাবস্থায় এদের স্পর্শ করবেন না। তবে এদের খাঁচার খুব কাছে থেকে এদের সাথে পুনঃ পুনঃ কথা বলতে থাকুন। এরপর ধীরে ধীরে এদের পোষ মানানোর চেষ্টা করতে থাকুন।
কবুতরকে আপনার ঘরের ভেতর বিচরণ করতে দিন
কবুতরকে আপনি খাঁচা থেকে মুক্ত করে দিন ও আপনার ঘরের কোনো ছোট কামরা থাকলে সেখানে বিচরণ করতে দিন। এটি প্রতিদিন করতে থাকলে আপনার কবুতর ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে যাবে। আর এতেকরে আপনি হাত দিয়েও ধরতে পারবেন এদের। আর কবুতর একবার হাতে আসা শুরু করলে এদের নিয়মিত হাতে নিতে থাকুন। এতে আপনার সাথে কবুতরের সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হতে থাকবে আর কবুতর সহজেই পোষ মেনে যাবে।
- কবুতর মানুষের জন্য কিছু সংক্রামক রোগ উদ্রেক করতে পারে। যেমন সিটাকোসিসি। তাই ঘরের কোনো সদস্যের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং নিশ্চিত হয়ে নিন যে তারা কবুতরের সাথে একই স্থানে থাকতে পারবে কিনা।
- কবুতর হাত দিয়ে ধরার পর সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিন। কারণ কবুতর সালমোনেলা জীবাণু বহন করে।
- কখনই কবুতরকে বাড়ির পোষা কুকুর কিংবা বিড়ালের কাছাকাছি রাখবেন না।
আপনার কবুতরকে বাইরে বের করুনঃ
যদিও কবুতর ঘরের ভেতরেই দিব্যি থাকতে পারে তবুও বাইরের পরিবেশ এরা আরও বেশি উপভোগ করে। একারণে ঘরের চারপাশে ঘের দিতে পারেন। এজন্য ব্রিডারদের সাথে কথা বলে জেনে নিতে পারেন যে কবুতরগুলো মুক্তভাবে ওড়ার মত সক্ষম কিনা।
কবুতরের জন্য সঙ্গী নির্বাচন করুনঃ
কবুতরেরা সাধারণত একগামি হয়ে থাকে এবং বংশের ধারা অব্যাহত রাখতে এরা নিয়মিত মিলন করে থাকে। তবে এরা কিন্তু এদের এলাকার প্রতি বেশ রক্ষণশীল হতে পারে। তাই লড়াই এড়াতে দুটো কবুতরকে খুব ধীরে সুস্থে একে অপরের সাথে পরিচিত করান। এর জন্য শুরুতে আপনি একটি কবুতরকে কিছুদিন খাঁচায় আর অপরটিকে বাহিরে রেখে পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করতে পারেন।