রাজকীয় বেঙ্গল টাইগার

  

রয়েল বেঙ্গল টাইগার হল বড় বিড়াল (Big Cat Family) পরিবারের  মধ্যে সবচেয়ে বড়। প্রাণীটি দেখতে যতটা বড়, স্বভাবে ঠিক ততটাই রাজকীয়।

রাজার মত হেলেদুলে সুন্দরবনে বিচরণ করে এই বাঘ। তাই তো একে দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় পশুর মর্যাদা। তো চলুন জেনে নেয়া যাক এই রাজকীয় বাঘ সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও ইন্টারেস্টিং তথ্য।

পৃথিবীর বাঘের অধিকাংশই পাওয়া যায় বাংলাদেশ ও ভারতে। বাংলাদেশের কেবলমাত্র সুন্দরবনেই দেখা মিলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের। তাছাড়া রাশিয়ার সাইবেরিয়ায় 'সাইবেরিয়ান টাইগার' নামক বাঘের আরেকটি প্রজাতি পাওয়া যায় যা আকারে সবচেয়ে বিশাল। সাইবেরিয়ান টাইগার সাধারণত বরফ আচ্ছাদিত এলাকায় বিচরণ করে বলে এর গায়ে পুরু চামড়া ও লোমের আস্তরণ থাকে। 

এই বাঘের বৈজ্ঞানিক নাম Panthera Tigris . এটি Felidae পরিবারের Panthera গনের সদস্য। Panthera গণে মূলত বিগ ক্যাটসরা রয়েছে। অর্থাৎ বাঘ, সিংহ, জাগুয়ার, চিতাবাঘ, ক্লাউডেড লেপার্ড, স্নো লেপার্ড এগুলো রয়েছে। এদের মধ্যে বাঘ তথা রয়েল বেঙ্গল টাইগার আকৃতিতে সবচেয়ে বড়। 

বেঙ্গল টাইগার সম্পর্কে একটি অবাক করা তথ্য হল যে কোনো দুটি বাঘের চামড়ার ডোরাকাটা দাগের প্যাটার্ন কখনই মিলবে না। এটি অনেকটা আমাদের ফিঙ্গার প্রিন্টার মতই ইউনিক। এতে করে বাঘশুমারির জন্য প্রতিটি বাঘকে আলাদা করে শনাক্ত করা সম্ভব। 

বেঙ্গল টাইগার ১০-১৫ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। গড়পড়তায় একটি পুরুষ বাঘের ওজন হয় ২২৫ কেজি  আর স্ত্রী বাঘের ওজন হয় ১৩৫ কেজির কাছাকাছি। পুরুষ বাঘ দৈর্ঘ্যে প্রায় ৯ ফিট আর স্ত্রী দৈর্ঘ্যে প্রায় ৮ ফিট হয়ে থাকে। এদের অত্যন্ত শক্তিশালী ও মজবুত কেনাইন দাঁত রয়েছে যা প্রায় ৭.৫ থেকে ১০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়ে থাকে।  বিগ ক্যাটদের মধ্যে এদের দাঁতই সবচেয়ে বড়।  এদের লেজ সাধারণত ৩৫-৪০ ইঞ্চি লম্বা হয়।

তো বাঘ মামা খায় কি? আমরা সবাই জানি যে বাঘ মাংসাশী প্রাণী। এরা মাংস ছাড়া আর অন্যকিছু  খায় না। এরা সাধারণত তৃণভোজী বন্যপ্রাণী যেমন  হরিণ, বুনো শুয়োর, গউর ইত্যাদি শিকার করে এদের মাংস ভক্ষণ করে থাকে। এরা এক বসাতে প্রায় ৪০ কেজির মত মাংস খেতে পারে। ভাবা যায়?! বাসায় ট্রাই কইরা দেইখেন কয় কেজি খাইতে পারেন। 

বেঙ্গল টাইগার হল জন্মগত শিকারি। প্রকৃতি এদের দিয়েছে হত্যা করার সকল অস্ত্র। ১০ সেন্টিমিটার বড়শির মত নখ আর ৭.৫  সেন্টিমিটার কেনাইন দাঁতে সজ্জিত হয়ে এরা কারো ওপর ঝাঁপিয়ে পরলে মুহূর্তেই মৃত্যু নিশ্চিত। এরা শিকার ধরতে সুচতুর কৌশল অবলম্বন করে থাকে। এদের দক্ষতা রয়েছে মুহূর্তের মধ্যে হত্যা করার। 

অধিকাংশ সময় বাঘ রাতেই শিকারে বের হয়। এরা এদের শিকার ধরতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে থাকে। একটা ছোট হরিণ শিকারের আগে এরা যেরকম প্ল্যান পরিকল্পণা করে তা যদি আপনি আমি করতাম তাহলে এতদিনে জগদ্বিখ্যাত হয়ে যেতাম। বেঙ্গল টাইগার শিকার ধরার জন্য পারলে গাছেও চড়তে চেষ্টা করে, যদিও এরা গাছে আরোহনে খুব একটা পারদর্শী নয়। এরা যেমন হিংস্র ঠিক তেমনি প্রচণ্ড শক্তিশালী। নিজেদের চেয়ে ওজনে বিশাল কয়েক টনের ভারতীয় বাইসনের দেহ এরা অনায়াসেই টেনে নিয়ে যেতে পারে। 

রয়েল বেঙ্গল টাইগার স্বভাবে হিংস্র প্রজাতির। একা থাকতে পছন্দ করে এরা। তবে শুধুমাত্র শীতকালে এদের ৩/৪ জনের দল গঠন করে থাকতে দেখা যায়। এরা বেশ দ্রুতগামী ও দক্ষ সাঁতারু। এদের সাধারণত তৃণভূমি, ম্যানগ্রোভ ও জলাভূমিতে বিচরণ করে থাকে। এদের প্রজননের জন্য নির্দিষ্ট কোন ঋতু নেই তবে শীতকালে এদের প্রজননের হার বেশি পরিলক্ষিত হয়। 

বেঙ্গল টাইগার একবারে ৪-৫ টি শাবক প্রসব করতে পারে; গর্ভকাল সাধারণত ৩ মাস। এদের স্মৃতিশক্তি প্রখর। এরা একবার কোনো মুখ চিনে রাখলে তা ভুলে না। এমনকি মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের তুলনায় এদের স্মৃতিশক্তি ভাল। একটি বাঘ আরেকটি বাঘের সাথে লড়াই করার সময় কখনই গর্জন করে না। শুধু গরগর ও হিসহিস শব্দ করে। তবে এরা যথাসম্ভব লড়াই এড়িয়ে চলতে চায়। কারণ এরা সিংহের মত প্রাইডে দলবদ্ধ হয়ে  থাকেনা। সেকারণে আহত হলে শিকার করতে না পেরে অনাহারে মারা যাবার সম্ভাবনা বেশি। 

আহত হলে বেঙ্গল টাইগার তার ক্ষতস্থান জিভ দিয়ে চাটতে থাকে। কারণ বাঘের লালায় বিদ্যমান লাইসোজাইম এন্টিবায়োটিক হিসেবে কাজ করে। এতে করে এদের রক্তপাতও বন্ধ হয় আর ঘা সেরে যায়। 

এরা এদের পরিবার ও সন্তানদের যথেষ্ট প্রতিরক্ষা দেয়। এলাকা চিহ্নিত করার জন্য এরা আশেপাশের কোন ঝোপ কিংবা পাথরের দেয়ালে মূত্র ও কস্তুরী মিশ্রিত স্প্রে করে। বাঘের গর্জন প্রায় কয়েক মাইল ব্যাপী শোনা যায়। 

বেঙ্গল টাইগার রাতেই অধিকাংশ শিকার করে। এরা শিকারের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে। শিকারের ঘাড়ে ৭.৫ সেন্টিমিটারের দাঁত বসিয়ে স্নায়ুরজ্জু ড্যামেজ করে দেয়। এর ফলে শিকার মুহূর্তেই নড়াচড়া বন্ধ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। মৃত্যু নিশ্চিত হলে বাঘ তাঁর শিকারকে টেনে নিয়ে যায় তার পছন্দসই স্থানে আয়েশ করে ভোজ করার জন্য।

বাঘ খুব ভাল সাঁতার কাটতে পারে। আর এরা পানি বেশ পছন্দ করে। তাই সুন্দরবনে অনেক মানুষ ঠিক নৌকায় করে নদী পারাপারের সময় বাঘের মুখে পড়ে।  

এদের পেছনের পা সামনের পা অপেক্ষা কিঞ্চিৎ বড়। একারণে এরা প্রায় ২০-৩০ ফিট ঝাঁপ দিতে সক্ষম। এদের রাতের বেলা দৃষ্টিশক্তি মানুষের চেয়ে অনেক ভাল আর এই অসীম ক্ষমতাই এদের সুপার হান্টার বানায়। 

২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে মাত্র ৪৪০ টি বেঙ্গল টাইগার রয়েছে। ভারতে রয়েছে ২৯৬৭ টি। বাঘ সংখ্যার সাম্প্রতিক  হিসেব রাখা সবসময়ই সরকারের একটি উদ্বেগ এবং সরকার এই রাজকীয় প্রাণীটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষায় বদ্ধপরিকর। তারপরেও অবৈধ শিকার, বনাঞ্চল ও আবাস ধ্বংস, পোচিং ও কালোবাজারের ফলে বাঘ সংখ্যা দিনে দিনে কমে আসছে।