রাস্তায় হঠাৎ কুকুর কামড়ালে করলে আতঙ্কিত হওয়া অতি স্বাভাবিক। কুকুর কাউকে
আঁচড় বা কামড় দিলে বেশিরভাগ মানুষ শুধু জলাতঙ্কের কথা চিন্তা করে আতঙ্কিত হলেও ধনুষ্টংকারসহ বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগের সংক্রমণও ঘটতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না পেলে জলাতঙ্ক মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাছাড়া আক্রান্ত স্থানে নানাবিধ সংক্রমণ ছড়িয়ে সমস্যাকে আরও জটিল করতে পারে।
কুকুরের কামড় বেশ যন্ত্রণাদায়কও। আমাদের দেশে কুকুরের আক্রমণের ঘটনা সবচেয়ে
বেশি ঘটে আগস্ট থেকে নভেম্বর মাসে। রাস্তাঘাটে কুকুরের আক্রমণের শিকার হলে কিছু প্রাথমিক ও জরুরি পদক্ষেপ নিনঃ
প্রথমেই যা করবেন: প্রথমেই আক্রান্ত স্থানে ক্ষত ও রক্তপাতের তীব্রতা খেয়াল করুন। কুকুর কামড়ালে প্রথমে ক্ষতস্থান চেপে ধরুন, এতে তাড়াতাড়ি রক্তপাত বন্ধ হয়। এরপর কলের পানি দিয়ে অন্তত দশ মিনিট ধরে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করুন। যদি সম্ভব হয় তবে কোনো অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল সাবান ব্যবহার করতে পারেন ক্ষতস্থান উত্তমরূপে পরিষ্কারের জন্য। এটি ক্ষতস্থানের ব্যাকটেরিয়া পরিষ্কার করতে সাহায্য করবে। আক্রান্ত স্থানকে উঁচু করে রাখার যথাসম্ভব চেষ্টা করুন।
ক্ষত পরিষ্কার হয়ে গেলে দেরি না করে ক্ষতপরবর্তী সংক্রমণের হার কমাতে নিকটস্থ হাসপাতাল থেকে ক্ষতস্থানে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক মলম লাগিয়ে একটি জীবাণুমুক্ত গজ কাপড় দিয়ে ব্যান্ডেজ করে ফেলুন। ওষুধ-পথ্য সেবনের পাশাপাশি অবশ্যই প্রতিদিন কামড়ের ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতে হবে। কোনোভাবেই ধুলো-বালি ও ময়লা যাতে না লাগে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। ক্ষতস্থান শুকিয়ে আসা পর্যন্ত এ নিয়ম মেনে চলা উচিত। ক্ষতস্থানে অনেক বেশি ব্যথা হলে তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্যারাসিটামল কিংবা অন্যান্য ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করতে পারেন।
সম্ভব হলে যে কুকুরটি কামড় দিয়েছে তার দিকে লক্ষ্য রাখুন। কামড়ানোর কিছুদিনের মাঝে কুকুরটি যদি মারা যায় তাহলে আপনাকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আর এরকম হলে বিষয়টি অবশ্যই আপনার চিকিৎসককে জানান।
যা করবেন না: কখনোই খালি হাতে ক্ষতস্থান স্পর্শ করবেন না। ক্ষতস্থানে কোনোরকম তেল, গাছের রস, মাটি, পানের পাতা, গোবর,চুন ইত্যাদি ভুলেও লাগাবেন না। ক্ষতস্থানে কোনো সেলাই দেবেন না এবং ক্ষতে চিনি, লবণ ইত্যাদি ব্যবহার করবেন না।
এরপর যা করবেন: কুকুর কামড়ালে বা আঁচড় দিলে একদমই দেরি না করে নিকটস্থ হাসপাতাল বা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে জলাতঙ্ক ও ধনুষ্টংকারের টিকা গ্রহণ করবেন। যদি জলাতঙ্কের লক্ষণ প্রকাশ পায় তাহলে আপনার দুর্ভাগ্য। জলাতঙ্ক রোগ কিন্তু শতভাগ প্রাণঘাতী। এ রোগ একবার হলে মৃত্যু হবেই। সাধারণত এ রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই রোগী মৃত্যুবরণ করে। কোনো অ্যান্টিবায়োটিক এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে না। তবে কুকুরের কামড়ের পর জলাতঙ্কের লক্ষণ প্রকাশ পেতে কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস অবধি সময় লাগতে পারে। জলাতঙ্কের জন্য দুই ধরনের টিকা রয়েছে। ক্ষতস্থানের তীব্রতা ও আধিক্যের উপর ভিত্তি করে কারো ক্ষেত্রে একধরনের, আবার কারো কারো ক্ষেত্রে উভয় ধরনের টিকারই প্রয়োজন পড়ে। যত তাড়াতাড়ি জলাতঙ্কের টিকা নেওয়া যায়, ততই ভালো। জলাতঙ্কের আধুনিক টিকার ৫টি ডোজ রয়েছে। সবগুলো ডোজ সময়মত নিয়মানুযায়ী গ্রহণ করে টিকার কোর্স সম্পন্ন করা উচিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, কুকুর আক্রমণ করেছে এরকম ব্যক্তিদের মূলত তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যায়, যেমন-
প্রথম ক্যাটাগরি: যাদের শরীর কুকুর জিভ দিয়ে চেটেছে কিংবা শরীরের সাথে কুকুরের লেজের স্পর্শ লেগেছে কিংবা কুকুরের শরীরের কোনো লোমশ অংশ আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের সংস্পর্শে এসেছে। আবার কুকুরকে খাওয়ানোর সময় গায়ে কুকুরের লালা লেগেছে কিন্তু কোনো ক্ষত তৈরি হয়নি এবং রক্তপাত হয়নি, কেবল তারাই প্রথম ক্যাটাগরি এর অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের ব্যক্তিদের জলাতঙ্কের টিকা নেওয়ার প্রয়োজন নেই। লালা লেগে থাকে স্থানটি শুধু সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেললে কিংবা এন্টিসেপটিক দ্রবণ দিয়ে পরিষ্কার করলেই চলবে।
দ্বিতীয় ক্যাটাগরি: যদি আক্রান্ত স্থানে কুকুরের আঁচড় অথবা কামড়ের দাগ দেখা যায় কিন্তু ক্ষতস্থান থেকে কোনো রক্তপাত না হয়, তাহলে তারা দ্বিতীয় ক্যাটাগরি এর অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষতস্থান পরিষ্কার করার পাশাপাশি অবশ্যই জলাতঙ্কের টিকা গ্রহণ করতে হবে। মূলত জলাতঙ্কের টিকা চামড়ার নিচে দেওয়া হয়। কুকুর আঁচড় বা কামড় দেওয়ার অন্ততপক্ষে ৫ দিনের মধ্যে এ টিকা নিলে সবচেয়ে উত্তম। কুকুর দ্বারা আক্রান্ত নারী যদি গর্ভবতী হয় তাহলেও এটি দেওয়া যাবে।
তৃতীয় ক্যাটাগরি: কুকুর কামড়ালে যদি রক্ত বের হয়, কুকুর যদি দাঁত বসিয়ে দেয় বা মাংস খুবলে নিয়ে যায়; তবে আক্রান্ত ব্যক্তি তৃতীয় ক্যাটাগরির অন্তর্গত। আবার দ্বিতীয় ক্যাটাগরির ক্ষত যদি গলা, মাথা, বুক বা কাঁধে হয়; তবে সেটিও তৃতীয় ক্যাটাগরি এর অন্তর্ভুক্ত হবে। তৃতীয় ক্যাটাগরির ক্ষেত্রে ক্ষতস্থান যথাসম্ভব পরিষ্কার করতে হবে এবং জলাতঙ্কের টিকার পাশাপাশি হিউম্যান র্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন ইনজেকশনও অবশ্যই প্রয়োগ করতে হবে।
কুকুর কামড়ালে অথবা পরিবারের কারো এ জলাতঙ্ক রোগ হলে আক্রান্ত ব্যক্তির খাওয়ার পরে প্লেটের অবশিষ্ট খাবার অন্যদের খাওয়া উচিত নয়। জলাতঙ্কের পাশাপাশি ধনুষ্টংকারের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য কুকুর কামড়ালে দেরি না করে ২৪ ঘণ্টার ভেতরেই ধনুষ্টংকারের টিকা নেওয়া উচিত। কুকুর কামড়ালে যেকোনো জটিলতায় নিকটস্থ চিকিৎসকের সাথে বা হাসপাতালে যোগাযোগ করা জরুরি।