আক্ষরিক অর্থেই ওরাংওটাং নামটি দ্বারা 'পারসন অব দ্য ফরেস্ট' কিংবা 'বনের মানুষ' বোঝানো হয়। নামটি
মালয় এবং ইন্দোনেশিয়ান ভাষা ওরাং(মানুষ) এবং হুটাং(বন) হতে উৎসারিত।ওরাংওটাং অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী যা স্পষ্টভাবে যুক্তি ও চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা রাখে। আমাদের সাথে তাদের রয়েছে অস্বাভাবিক সাদৃশ্য । শিশু ওরাংওটাং ক্ষুধার্ত অবস্থায় কাঁদে, যখন তারা আহত হয় তখন গোঙ্গানি দেয় এবং মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসতেও পারে। অবাক করার মত কথা হল তারা ঠিক আমাদের মতো করেই আবেগ আনন্দ, ভয়, রাগ প্রকাশ করে থাকে।
আপনি যদি কয়েক মিনিট সময় নিয়ে একটি ওরাংওটাংকে পর্যবেক্ষণ করেন, তবে আপনি হলপ করে বলবেন যে এরা তো আমাদেরই মতো।
ওরাংওটাং আকারে বেশ বড়সড় হলেও এরা অনেক শান্তশিষ্ট একটি প্রাণী। পূর্ণবয়স্ক পুরুষ রগচটাও হতে পারে কিন্তু অধিকাংশ সময় তারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে। এরা তাদের সারাটি জীবন গাছের উপরেই পার করে দেয়। কারণ এতে তাদের শিকারির হাত থেকে সুরক্ষা মিলে। একান্তই প্রয়োজন না পরলে তারা মাটিতে পা দেয়না। শিশু ওরাংওটাং এর চেঁচামেচি কিংবা কদাচিৎ পূর্ণবয়স্ক পুরুষের লম্বা ডাক ছাড়া তাদের অবস্থান জানতে পাড়া বেশ শক্ত। এরা খুব নিরীহ প্রাণী, সর্বদা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে। একে অপরের ব্যাপারে নাকও গলায় না, যেটা খুব ইন্টারেস্টিং একটি ব্যাপার।
স্থানীয় পৌরাণিক কাহিনীতে উল্লেখ আছে ওরাংওটাংরা আসলে কথা বলতেও পারে। কিন্তু তারা মুখ বন্ধ রাখে এই ভয়ে যে কেউ যদি তাদের ধরে তাহলে সাথে সাথে তাদের কাজে লাগিয়ে দিবে।
প্রাগৈতিহাসিক যুগে ওরাংওটাং এর বিস্তৃতি ছিল সমগ্র এশিয়া মহাদেশে বিশেষ করে চীনের উত্তরাংশ পর্যন্ত। বর্তমানে মানুষের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও ব্যাপক বনাঞ্চল ধ্বংস করার প্রবণতার ফলে এদের দেখা মিলে কেবল ইন্দোনেশিয়ার বোর্নিও এবং সুমাত্রায়। কারণ কেবলমাত্র এই দুটি স্থানেই এদের বংশবিস্তার করার জন্য যথেষ্ট বনাঞ্চল রয়েছে। কিন্তু তারপরেও এই দুটি স্থানেও বনাঞ্চল খুব দ্রুতই হ্রাস পাচ্ছে। বিগত ৫০ বছর ধরেই তাদের আবাস নগরায়নের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাপকভাবে। বিশেষত পাম অয়েলের বিশ্বব্যাপী চাহিদার জন্য পাম গাছের আবাদের জন্য ব্যাপক পরিমাণে বন্যভুমি ধ্বংস করা হচ্ছে। আর এটি ক্রমাগত চলতে থাকলে একসময় এই প্রাণীটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
ওরাংওটাং প্রধানত তিনটি প্রজাতিতে বিভক্ত। এগুলো হলঃ সুমাত্রান, বোর্নিও ও তাপানুলি(যেটি একমাত্র সুমাত্রায় পাওয়া যায়)। সাধারণত বোর্নিও ওরাংওটাং তাদের সুমাত্রান জাতভাইদের তুলনায় কিছুটা ছোট ও অপেক্ষাকৃত গাঢ় কমলা বর্ণের হয়ে থাকে। পুরুষেরা উচ্চতায় সাধারণত সাড়ে ৪ ফিট ও স্ত্রীরা সাড়ে ৩ ফিট হয়ে থাকে। এদের হাতগুলো পায়ের তুলনায় অনেক লম্বা থাকে। পুরুষেরা দুহাত বিস্তৃত করলে তা প্রায় ৮ ফিটের সমান হয়। পূর্ণবয়স্ক পুরুষেরা ওজনে সাধারণত ২০০-২৫০ পাউন্ড ,স্ত্রীরা ১০০-১৫০ পাউন্ডের হয়ে থাকে। গড়পড়তায় স্ত্রী ওরাংওটাং পুরুষের সাইজের প্রায় অর্ধেক হয়ে থাকে।
বুনো অবস্থায় এরা ৩৫-৪০ বছর বাঁচতে পারে। তবে বন্দি অবস্থায় যথাযথ পরিচর্যায় এরা ৫০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে সক্ষম।
এদের একটি বিশেষ ব্যাপার হল এরা ৬-৭ বছরে কেবলমাত্র একটি সন্তানই প্রসব করতে পারে। আর বাচ্চারা কখনই তাদের মাকে ছেড়ে চলে যায় না। পৃথিবীর পশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে মায়ের পরিচর্যায় থাকে ওরাংওটাং।
তরুণ পুরুষেরা মা হতে দূরে সরে যায় যখন তারা বয়ঃসন্ধিতে পৌছায়। আর স্ত্রীরা তাদের নিজেদের বাচ্চা হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মায়ের সাথেই থেকে যায়। পুরুষেরা পূর্ণবয়স্ক হলে নতুন এলাকা ও স্ত্রী ওরাংওটাং এর খোঁজে বের হয়।
এদের আহারে অন্তর্ভুক্ত থাকে মূলত গাছের বাকল, পাতা, ফুল, পোকামাকড় এবং শত প্রজাতির ফল। এরা কাঁচা কনবা পাকা উভয় অবস্থাতেই ফল খেতে সক্ষম। শিশু ওরাংওটাংদের শত শত প্রজাতির গাছ চিনে রাখা শিখতে হয়, যাতে তারা বুঝতে পারে যে কোনটি খাদ্য আর কোনটি অখাদ্য। এরা এদের পা দুটোকেও ঠিক হাতের মত ব্যবহার করতে পারে।
পূর্ণবয়স্ক পুরুষের গলায় বেশ বড় একটি থলে রয়েছে। এটির ফলে পুরুষেরা আলাদা রকমের গম্ভীর শব্দ তৈরি করতে পারে। অনেকটা সিংহের গর্জনের মত। এটিকে 'লং কল' বলা হয়। এই লং কল পুরো বনের গাছ গাছালিতে প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে আর এতে করে বনে থাকা স্ত্রী ওরাংওটাংরা আকৃষ্ট হয় এবং একই সাথে অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী পুরুষেরা দূরে সরে যাবার সতর্কবাণী পেয়ে যায়। পূর্ণবয়স্ক পুরুষের গালে আলাদা রকমের বড় বড় 'চিক প্যাড' থাকে।
ওরাংওটাংরা গাছের অনেক উঁচুতে বাসা বাঁধে এবং প্রতিদিন তারা নতুন করে আলাদা গাছে বাসা বানায়। এদেরকে হাতিয়ার বানাতে ও ব্যবহার করতেও দেখা গেছে। তারা গাছের শাখা প্রশাখা ভেঙ্গে তা দিয়ে কাঠি বানিয়ে উঁইপোকার গর্তে ঢুকিয়ে তা থেকে উঁইপোকা বের করে খায়। পানির সঙ্কটের সময় তারা গাছের পাতা চিবিয়ে তা স্পঞ্জের মত করে যাতে সেখানে বৃষ্টির পানি সহজে জমতে পারে।আর বৃষ্টির সময় এরা গাছের পাতা জড় করে তা দিয়ে ছাতা বানিয়ে নিজেদেরকে ভিজে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচায়।
ওরাংওটাং এর প্রধান হুমকি হল রেইনফরেস্ট ধ্বংস করা। মূলত পাম গাছের আবাদের জন্যই রেইনফরেস্ট পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়। আমরা পাম অয়েলের ব্যবহার কমিয়ে দিয়ে কিংবা ব্যবহার না করে এই সুন্দর ও নিরীহ প্রাণীটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে পারি।