বৈচিত্র্যময় তিলা ঘুঘু

Nature, Bird, Wildlife, Animal, Wing, Spotted, Dove

 

তিলা ঘুঘুর  বৈজ্ঞানিক নাম: Streptopelia chinensis) । এটি Columbidae (কলাম্বিডি) গোত্র বা পরিবারের Streptopelia (স্ট্রেপ্টোপেলিয়া) গণের অন্তর্ভুক্ত অত্যন্ত সুলভ এক প্রজাতির ঘুঘু। এটি বেশ সুলভ একটি পাখি । তাই এদের রয়েছে অনেকগুলো নাম: তিলা ঘুঘু, তেলিয়া ঘুঘু, ছিটে ঘুঘু ইত্যাদি। বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও এ পাখিটিকে  দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। সারা পৃথিবীতে প্রায় ১ কোটি ৩ লাখ বর্গ কিলোমিটারের এক বিশাল এলাকা জুড়ে এদের আবাস রয়েছে ।  বিগত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে। তাই আই. ইউ. সি. এন. এই প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ পাখিটি একটি সংরক্ষিত প্রজাতি ।

তিলা ঘুঘু এদের একই গণের অন্যসব প্রজাতি থেকে বেশ খানিকটা আলাদা; কেবল খুদে ঘুঘুর (Streptopelia senegalensis) সাথে এর কিছুটা মিল লক্ষ করা যায়।


Spotted Dove, Pigeon, Bird, Spilopelia Chinensis

 

তিলা ঘুঘুর মাথার চাঁদি ও কান-ঢাকনি ধূসর বর্ণের হয়ে থাকে। ঘাড়ের পেছনের উপরিভাগ কিছুটা পাটল বর্ণের। ঘাড়ের পাশে অ ঘাড়ের পেছনের নিচের ভাগ সাদা-কালো তিলার পট্টি রয়েছে। এদের পিঠ বাদামি বর্ণের ও ডানায় পীতাভ তিলা রয়েছে। চোখের রঙ ফিকে লালচে বাদামি। চোখের পাতা ও অক্ষি গোলকের মুক্ত পট্টি অনুজ্জ্বল গাঢ় লাল বর্ণের। ঠোঁট কালচে। এদের পা ও পায়ের পাতা লাল রঙের এবং নখর বাদামি। পুরুষ ও স্ত্রী পাখি দেখতে প্রায় একই রকম।

 



 
গ্রামবাংলার কোনো পথ দিয়ে হাঁটার সময় যেসব পাখির সুরেলা সুমধুর কণ্ঠ কানে ভেসে আসে, তাদের পাখির মধ্যে তিলা ঘুঘু বেশ সুপরিচিত এক পাখি। এরা গ্রামের মাঠেঘাটে, শস্যভিটায়, একাকী কিংবা জোড়ায় হেঁটে হেঁটে খুঁটে খুঁটে শস্যদানা খায়। জনমানুষের আভাস পাওয়া মাত্রই একটু থমকে দাঁড়ায়, পরক্ষণই দেখেশুনে আবারও হাঁঁটতে শুরু করে। মানুষের দূরত্ব যদি নিরাপদ সীমা অতিক্রম করে, তখনই এরা ডানা ঝাপ্টিয়ে উড়াল দেয়।



 
 
তিলা ঘুঘু বিচরণ করে আর্দ্র পাতাঝরা বন, কুঞ্জবন, বাগান এবং আবাদি জমিতে। গ্রাম ও শহর কমবেশি সবখানেই এই পাখির দেখা মিলে। সচরাচর জোড়ায় বা ছোট দলে বিচরণ করে এরা। তৃণভূমি, খামার, চাষের জন্য কর্ষিত জমি, প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে শুরু করে জুলাই মাসে পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখির পাশে এসে মাথা নাচিয়ে অবিরাম ডেকে চলে। কোমল সুরে ক্রক..ক্রক ক্রুক্রু... করে ডেকে চলে। কাঁটাওয়ালা ঝোপ, বাঁশঝাড়, খেজুর কিংবা অন্যান্য ছোট গাছে এমনকি দেয়ালের কার্নিশেও  কাঠি বিছিয়ে বাসা বানিয়ে এরা ডিম পাড়ে। ডিমগুলো সাধারণত সাদা বর্ণের হয়ে থাকে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে সাধারণত ১৩ দিন সময় লাগে।


 
এখন পর্যন্ত  তিলা ঘুঘুর মোট তিনটি উপপ্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে ।
এ উপপ্রজাতি তিনটি হল-
• S. chinensis chinensis (J. F. Gmelin, 1789) – মধ্য ও পূর্ব চীন ,তাইওয়ান এবং  মিয়ানমার জুড়ে এদের বিস্তৃতি রয়েছে। 
 
• S. chinensis suratensis (Scopoli, 1786) – পাকিস্তান, নেপাল, দক্ষিণ ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও আসামে এদের দেখা পাওয়া যায়।
 
• S. chinensis tigrina (Temminck, 1810) – এদের মূল আবাস বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভারতের একদম উত্তর-পূর্বাঞ্চল, থাইল্যান্ড, সমগ্র ইন্দোচীন, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, পূর্ব তিমুর ও ব্রুনাই ।
 
ঘুঘুটির উপপ্রজাতিগুলোর মধ্যে ceylonensis ও hainana প্রস্তাবিত হয়েছে, কিন্তু এখনও তা প্রমাণিত নয়। অস্ট্রেলিয়া, ফিজি, মরিশাস,নিউ ক্যালিডোনিয়া, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে পাখিটিকে অবমুক্ত করা হয়েছে। মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানেও এরা রয়েছে তবে অনিয়মিত।
 
 
 
শৈশবে কাউবয় হ্যাট পরিহিত অনেক শহুরে সাহেবকে এয়ারগান নিয়ে গ্রামে পাখি শিকারে আসতে দেখেছিলাম। তারা যেসব পাখি শিকার করত, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় থাকত তিলা ঘুঘু। তবে দিন বদলেছে । এখন গ্রামের মানুষ অনেক সচেতন, এয়ারগানও নিষিদ্ধ হয়েছে। আর একারণেই তিলা ঘুঘুর সংখ্যা দেশে খুব একটা কম নয়। তারপরেও বনের এই ঘুঘু রাজধানীর কাঁটাবনে পাখির দোকানসহ বিভিন্ন পাখি ব্যবসায়ীদের খাঁচায় দেখা যায়। এ ব্যাপারে আইনের সঠিক প্রয়োগ অবশ্যই কাম্য।