মিঠাপানির কুমির (Crocodylus palustris) মূলত স্বাদুপানির জলাশয়সমুহ যেমন নদ-নদী, খাল-বিল, পাহাড়ি ঝিরিপথে পাওয়া যায়। এমনকি এককালে এগুলো বাংলাদেশের পুকুর ও ডোবাতেও
অহরহ পাওয়া যেত যেটি বেশ আতঙ্কের। পুকুরে ওঁত পেতে থেকে মানুষের গরু-ছাগল ধরে নিয়ে যাবারও বেশ কুখ্যাতি রয়েছে এই সরীসৃপটির। যদিও আজ এ প্রজাতিটি বাংলাদেশে বিলুপ্ত। মাছ শিকার বেড়ে যাওয়ায় জালের মধ্যে আটকে মারা পড়তে থাকে অনেক কুমির। কালের বিবর্তনে প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে হারিয়ে যায় এ কুমির।যদিও নাম মিঠাপানির কুমির, এরা কিন্তু লোনা জলেও দিব্যি চলতে পারে। সাধারণত পানির ৫ মিটারের গভীরতায় এরা অবস্থান করে থাকে। এরা জলাশয়ের পারে বিভিন্ন আকৃতির গর্ত করে সেগুলোতে অবস্থান করে থাকে। এরা ঋতুমাফিক পরিযায়ী নয় বরং বর্ষা ও শুষ্ক মৌসুমে একই স্থানে বসবাস করে।
মিঠাপানির কুমির দৈর্ঘ্যে প্রায় ৪-৫ মিটার হয়ে থাকে আর সর্বোচ্চ ৭০০ কেজি পর্যন্ত ওজন হয়। এদের পুরো শরীরে খসখসে শক্ত আঁশে আবৃত থাকে যা অনেকটা কাদার মত রঙ ধারণ করে। সকল প্রজাতির কুমিরের মধ্যে এদের তুণ্ড সবচেয়ে প্রশস্ত। এদের আকৃতিগত বৈশিষ্ট্য ব্যতীত স্ত্রী ও পুরুষ কুমিরের তেমন কোন শারীরিক পার্থক্য চোখে পড়ে না। পুরুষ কুমির স্ত্রী কুমিরের চেয়ে কিছুটা বড় আকৃতির হয়ে থাকে।
এদের ছানার দৈর্ঘ্য ০.২৭ মিটারের কাছাকাছি হয়ে থাকে আর ওজন হয় ৩০০ গ্রামের মত। ওজন ৩-৩০ কেজি হলে এদেরকে তরুণ কুমির হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তরুণ অবস্থায় এরা ১.৪ মিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হয়।
স্ত্রী কুমির সাধারণত ২৫-৩০ টি পর্যন্ত ডিম পেরে থাকে। ভালভাবে বেড়ে উঠতে এদের অনুকূল তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা প্রয়োজন। রেকর্ড করা হয়েছে যে সফলভাবে বৃদ্ধি এবং টিকে থাকতে এদের ঠিক ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন। আবার এদের লিঙ্গও নির্ধারণ হয় তাপমাত্রার পার্থক্যের দ্বারা। সাধারণত যেসকল ডিম ২৮-৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফুটে সেগুলো থেকে স্ত্রী কুমির আর যেসকল ডিম ৩২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফুটে তা থেকে পুরুষ কুমির জন্ম নেয়। স্ত্রী কুমির প্রায় ৮-১০ বছর পর যৌবনে পৌছায় এবং তখন এদের দৈর্ঘ্য হয় ১.৮-২ মিটার পর্যন্ত। পুরুষদের ক্ষেত্রে যৌন পরিপক্কতায় সময় লাগে প্রায় ১২-১৫ বছর।
স্ত্রী কুমির তার ছানাদের রক্ষা করে থাকে এবং যেকোনো আক্রমণ প্রতিহত করে। তবে পুরুষ কুমির ছানাদের রক্ষায় কোনো ভূমিকা রাখেনা।
এরা বন্য পরিবেশে প্রায় ২৮ বছরের মত এবং বন্দীদশায় ৩১ বছরের মত বাঁচতে পারে। এরা 'পইকিলোথারমিক' সরীসৃপ বিধায় এদের রোদ পোহানোর মাধ্যমে নিজেদের শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। এরা জলাশয়ের ধারে গর্ত করে থাকে যাতে চারপাশের তাপমাত্রার ক্রমাগত পরিবর্তন এদের শরীরের তাপমাত্রায় কোনো প্রভাব ফেলতে না পারে।
মিঠাপানির কুমির সাধারণত পানির উপরিতলে ভেসে এমনভাবে চলাচল করে যাতে কেবলমাত্র এদের তুণ্ড ও চোখ দৃশ্যমান হয়। পানির উপরিতলে অবস্থানকালীন এরা এদের চোখ, নাক ও কানের ওপর নির্ভর করে চলাচল করে। আর পানির নিচে অবস্থানকালে এরা এদের চামড়ার সাহায্যে অনুভূতি গ্রহণ করে থাকে। পানির মধ্যে মৃদু কম্পন হলেও এরা তখন বুঝতে পারে। এদের চামড়াই এদের একমাত্র সংবেদনশীল অঙ্গ। এটি এতটাই সংবেদনশীল যে এটি পানির পিএইচ(pH) আন্দাজ করতে পারে।
মিঠাপানির কুমির একটি সুযোগসন্ধানী শিকারি। অর্থাৎ চোখের সামনে নিজের আকৃতির চেয়ে ছোট কোনকিছু পেলেই সাথে সাথে ধরে খেয়ে ফেলবে। এমনকি স্বজাতিকেও এরা খেতে ছাড়েনা। এরা পানির নিচে ওঁত পেতে থাকে এবং সুযোগ বুঝে শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মাঝে মধ্যে এরা পানির পৃষ্ঠতল ঘেঁষে উরে চলা বাদুড় কিংবা পাখিকেও ধরে ফেলে। কুমিরের ছানা সাধারণত ছোট পোকামাকড় ও ব্যাঙ খেয়ে থাকে। শরীর ও বয়স বাড়ার সাথে সাথে এদের শিকারের সাইজও বাড়তে থাকে। কুমির এক বসায় সাধারণত নিজেদের ওজনের প্রায় ১০%-২৫% খাবার খেতে সক্ষম।
মিঠাপানির কুমির জলাশয়ের বাস্তুতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ এরা জলাশয়ের খাদ্য শৃঙ্খলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করে এবং জলাশয়ের অন্যান্য সকল প্রাণীদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অবদান রাখে।
মিঠাপানির কুমিরকে এদের মূল্যবান চামড়ার জন্য নিধন করা হয়। তবে মানুষ এদের আরও বিবিধ কারণে হত্যা করে থাকে। চামড়ার পাশাপাশি এদের হাড় ও আঁশ দিয়ে ঔষধ তৈরির উপকাথার প্রচুন রয়েছে। পোচাররা এদের ডিমও কালোবাজারে বিক্রি করে থাকে।
মিঠাপানির কুমির বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে বিলুপ্ত। এককালে পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র সহ অসংখ্য খাল্বিল ও জলাশয়ে এ কুমিরের বিস্তৃতি ছিল। তবে সরকারি পর্যায়ে সুন্দরবনের ‘করমজল বন্যপ্রাণী ও কুমির প্রজনন কেন্দ্র’ এ মিঠাপানির কুমিরের কৃত্রিম প্রজনন ও পালন করা হয়।