ধূসর বর্ণের মুখপোড়া হনুমান পুরো ভারতজুড়ে পাওয়া যায়। অবশ্য হিমালয়ের দক্ষিণে এবং বাংলাদেশের পশ্চিমেও দেখা মিলে এদের। এরা সাধারণত শুষ্ক ও পর্ণমোচী বনাঞ্চলে বাস করে এবং কিছু অংশ লোকালয়েও বসবাস করে থাকেে
। এ প্রাণীটি হিন্দুদের কাছে পবিত্র এবং ভগবান হনুমানের নামানুসারে এদের 'হনুমান লাঙ্গুর' বলা হয় হিন্দিতে। এরা পুরো ভারতবর্ষেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে এবং অনেক স্থানেই এদের খাওয়ানো হয়।পূর্ণবয়স্ক হনুমানের মাথা হতে শরীরের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৫ ইঞ্চি হয়ে থাকে। আর এদের দেখার মত লম্বা লেজটির দৈর্ঘ্য হয়ে থাকে ২৭-৪০ ইঞ্চি। পূর্ণবয়স্ক পুরুষ হনুমান স্ত্রীদের তুলনায় ৩০% বেশি বড় হয়ে থাকে। পুরুষ হনুমানের ওজন সাধারণত ১৭ কেজি হয় আর স্ত্রীদের ওজন সাধারণত ১১ কেজি হয়ে থাকে।
বন্দী দশায় এরা ৩০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে সক্ষম। বুনো পরিবেশে এরা ১৮ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে।
মুখপোড়া হনুমানের রয়েছে হলুদাভ রুপালী-ধূসর বর্ণের লোম আর এদের মুখটি কুচকুচে কালো হওয়ায় এরা 'মুখপোড়া' বিশেষত্বটি পেয়েছে। এদের হাত, পায়ের তালু ও কানের রঙও কালো। মুখমণ্ডলের চারপাশে সাদা লোম আবৃত। এদের পেট লালচে সোনালি বর্ণের। তরুণ পুরুষ হনুমানেরা বাদামি বর্ণের হয়ে থাকে , তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে এদের লোম ধূসর বর্ণ ধারণ করতে থাকে।
এদের লেজটি শরীরের তুলনায় প্রায় দেড়গুণ লম্বা। এটি এদের চলাচলে ভারসাম্য রাখতে সাহায্য করে।
মুখপোড়া হনুমানের খাদ্যাভ্যাসে এলাকাভিত্তিক তারতম্য দেখা যায়। এর কারণ মূলত বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন খাদ্যের প্রচলন। সাধারণত এরা মৌসুমি ফল খেয়ে থাকে। তাছাড়া এরা ফুল ও শত প্রজাতির উদ্ভিদের কচি পাতাও ভক্ষণ করে থাকে। এদের খাদ্যের প্রায় ৫০% থাকে গাছের পাতা। আর এদের পরিপাক তন্ত্র বিশেষভাবে অভিযোজিত। অন্যান্য পশুপাখি যেসব খাদ্য এড়িয়ে চলে এরা তাও খেতে সক্ষম। যেমন এরা ফলের বিষাক্ত বীজ খেতে পারে অনায়াসেই।
শহরে বসবাসকারী হনুমানেরা সাধারণত মানুষের দেয়া খাদ্য খেয়ে থাকে। মানুষ এদের বাদাম, রুটি, বিস্কুট ও ফল খেতে দেয়।
মুখপোড়া হনুমান এদের অর্ধেক জীবন কাটায় বৃক্ষে আর অর্ধেক জীবন কাটায় মাটিতে। তবে শহুরে এলাকায় এরা দালান কোঠা ও মন্দিরের ভেতরে বসবাস করে। এরা চার হাতপায়ে ভর দিয়ে চলে। এরা সাধারণত দৌড়ে দৌড়ে চলে। এরা দিবাচারী। রাতের বেলা ঘুমিয়ে পড়ে। মাঝে মধ্যে এদের টেলিফোন পোলেও ঘুমিয়ে থাকতে দেখা যায়। স্ত্রী হনুমানেরা দিনের অধিকাংশ সময় একে অপরের দেখভালে, উঁকুন বাছায় ব্যস্ত থাকে।
এরা একে অপরের সাথে বিভিন্ন স্বরে ও ইঙ্গিতে ভাব বিনিময় করতে পারে। একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে প্রায় ২০ ধরনের পৃথক স্বর ব্যবহার করে থাকে এরা। কোনটি কুকুরের মত ভুক ভুক শব্দ, ঘোঁত ঘোঁত শব্দ, সতর্ক সংকেত এবং পুরুষেরা দীর্ঘ 'হুউউপস' স্বরে ডাকতে পারে। পুরুষের এই ডাক প্রায় এক মাইল ব্যাপী শোনা যায়। দলকে একত্র করতে কিংবা শিকারির হাত থেকে সতর্ক করতে এরা পৃথক পৃথক স্বর ব্যবহার করে থাকে।
স্ত্রী হনুমান ৪-৮ বছর বয়সেই প্রজননে সক্ষম হয়ে ওঠে। গর্ভকাল সাধারণত ২০০ দিন হয়ে থাকে। এরা মূলত একবারে একটি সন্তান প্রসব করে।
প্রকৃতিতে মুখপোড়া হনুমানের গুরুত্ব অনেক। যেহেতু এরা ফল খেয়ে থাকে তাই এরা মলের দ্বারা হজম না হওয়া বীজ বিস্তারে সাহায্য করে থাকে। হরিণ ও গবাদি পশু গাছ হতে এদের ফেলে দেয়া ফল মূল খেয়ে থাকে।
মুখপোড়া হনুমান IUCN,2015 এর তথ্য অনুযায়ী সর্বনিম্ন উদ্বেগে রয়েছে। তবুও এদের সংখ্যা দিনে দিনে কমছে এদের প্রাকৃতিক আবাস ধ্বংস করার ফলে। এর কারণে এরা বেশি বেশি লোকালয়ে থাকতে শুরু করছে। এতেকরে লোকালয়ে মানুষ আর হনুমানের দ্বন্দ বেড়েই চলছে। অনেক স্থানে এরা সড়ক দুর্ঘটনারও শিকার হয়ে মারা পরছে। তবে এদের পবিত্র পদমর্যাদা ও কম আগ্রাসী স্বভাবের কারণে ভারতের অধিকাংশ স্থানে এদের ক্ষতিকারক মনে করা হয়না।