প্রজনন মৌসুমে পাখিরা পুরুষ ও স্ত্রী পাখিরা পরস্পর মিলিত হয়, ডিম পারে ও ছানা জন্ম দেয় আর ছানাদের রক্ষণাবেক্ষণ করে। সাধারণত বাংলাদেশ ও ভারতে পাখিরা গ্রীষ্মকালে বেশি প্রজনন করে থাকে। এর কারণ হল গ্রীষ্মকালে খাদ্যের প্রাচুর্য থাকে বেশি আর পরবর্তী ঋতুসমূহে টিকে থাকার জন্য ছানারা পর্যাপ্ত আহার পায়।
অধিকাংশ প্রজাতির পাখিদের ক্ষেত্রে প্রজনন কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক হলেও কিছু কিছু পাখিদের বেলায় নিজেদের ডিম ও ছানাদের রক্ষা করা যেন মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
পুরুষ কোকিল |
পাখিদের জগতে এক ধরনের বিশেষ পাখি রয়েছে যাদের বলা হয় 'Brood Parasite' , অর্থাৎ এ পাখিরা পরজীবী। এ ধরনের পাখিরা সাধারণত নিজেরা বাসা বানায় না , বরং এরা অন্য পাখির বাসায় নিজেদের ডিম পাড়ে ও ছানার লালন-পালনের ভার দিয়ে যায় সেই পোষক পাখির ওপর। বিবর্তনের মাধ্যমে ঘটা এ ধরনের বিশেষ আচরণ পরজীবী পাখিদের ছানাদের লালন পালনের সময় ও পরিশ্রম থেকে রেহাই দেয়। আর এ সময়টা তারা অন্য পাখির বাসা অনুসন্ধান , সেই বাসা থেকে লুণ্ঠন ও আরও ছানা জন্ম দেয়ার কাজে লাগায়। মানুষ এই Brood Parasitism সম্পর্কে শত শত বছর ধরে অবহিত থাকলেও ঠিক কোন কারণে ও কিসের প্রভাবে পরজীবী পাখিরা এরকম আচরণ করে তার সঠিক ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারেনি।
আমাদের অনেকেই ছোটবেলা থেকে কাকের বাসায় কোকিলের ডিম পাড়ার কথা শুনে আসছি। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষেরই এদের গতিবিধি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়, কারণ তা দৃষ্টির অগোচরেই থেকে যায়।
আমাদের দেশে কাকের প্রজনন ঋতু হয়ে থাকে সাধারণত বর্ষার শুরু থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত। আবার কোকিলের প্রজনন ঋতু হয়ে থাকে মার্চ মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত। এখানে দেখুন কোকিলের প্রজনন ঋতুর সাথে কাকের প্রজনন ঋতুর ওভারল্যাপ হচ্ছে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কিছু মাসে কাক ও কোকিলের উভয়েরই প্রজনন ঋতু থাকছে।
স্ত্রী কোকিল |
কোকিল বুদ্ধি করে কাকের বাসায় ডিম পাড়ে ঠিক এই কারণে যে কাকের ডিম সংখ্যা একাধিক হবার সম্ভাবনা থাকে। কোকিলের ডিমের প্যাটার্ন ও রঙ কাকের ডিমের মতই হয়। গবেষকরা দেখেছেন কোকিলের মত পরজীবী পাখিদের ডিমের রঙও হয় অন্যান্য পাখিদের ডিমের অনুকরণে। যেমন বাজ কোকিলের ডিমের রঙ ও আকৃতি হয় হুবহু সাতভাই ছাতারে (Jungle Babbler) পাখিদের ডিমের মত। ডিমের রঙ অনুকরণের এই বিবর্তন ঘটেছে মূলত যাতে পোষক পাখিরা এদের ডিমকে না সনাক্ত করতে পারে।
সাধারণত কোকিলের ডিম কাকের ডিমের তুলনায় একটু ছোট হয়ে থাকে। তবে কাক এটি মোটেও ধরতে পারেনা। আর ডিমের আকৃতি ছোট হওয়ায় এটি ফুটতেও অনেক কম সময় লাগে। তাই সবার আগেই কোকিলের ডিমটিই ফুটে।
কাক এর প্রজনন ঋতুতে সাধারণত গড়পড়তায় পাঁচটি ডিম পাড়ে। প্রতিদিন একটি করে ডিম পেড়ে থাকে। তার মানে পাঁচ দিনে পাঁচটি ডিম। আর ঠিক এ সময়ের মধ্যেই কোকিল কাকের বাসায় ডিম পাড়ে। যদি কোকিল এর একদিন আগেও ডিম পেড়ে থাকে তাহলে কোকিলের ডিম কাক চিনে ফেলে ও বাসা থেকে ফেলে দেয়। আর পাঁচদিন শেষ হবার পর ডিম পাড়লে ডিমটি পর্যাপ্ত যত্ন পায় না। তাই কাক ডিম পাড়া শুরু করার এক থেকে পাঁচদিনের মধ্যেই কোকিলরা কাকের বাসায় ডিম পেড়ে থাকে।
কাকের বাসায় হানা দেয়ার আগে স্ত্রী কোকিল কিছু পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করে। শুরুতেই এদের কৌশল থাকে কাকের বাসায় হানা দিয়ে এদের বাসা থেকে কিছু ডিম ফেলে নষ্ট করা। কিন্তু এটা তখনি করতে পারবে যখন কাকের বাসা খালি থাকবে। তাই এসময় স্ত্রী কোকিল গাছের কোন উঁচু মগডালে বসে কাকের বাসায় গোপনে নজর রাখে। স্ত্রী কোকিলের গায়ের রঙ বাজপাখির ন্যায় ছোপ ছোপ দাগযুক্ত। যার ফলে এরা সহজেই ডালপালা ও পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পাড়ে। যখনি সে দেখবে বাসায় স্ত্রী ও পুরুষ উভয় কাক নেই ঠিক তখনি সে কাকের বাসায় ডিম পারতে বসবে। ডিম পাড়ার আগেই যদি কাক চলে আসে তাহলে কাক এদের তাড়া করে খেদিয়ে দেয়। আর ঠিক এ মুহূর্তেই সে কাকের বাসা থেকে একটি কাকের ডিম সুচতুর কায়দায় নিজের ঠোঁটে চেপে নিয়ে উড়ে যায় ও উপর থেকে ফেলে দেয়। এভাবে কাকের বাসা থেকে একটি বা দুটি ডিম নষ্ট করে স্ত্রী কোকিল সুযোগ বুঝে কোনো এক সময় তার ডিমটি পেড়ে আসে।
স্ত্রী কোকিল কিন্তু সব ডিম একই কাকের বাসায় পাড়েনা। আলাদা আলাদা কাকের বাসায় সে একটি করে ডিম পাড়ে।
কোকিলের ডিম যেহেতু কাকের ডিমের আগে ফুটে তাই কাক শুরুতেই কোকিলের ছানাকে দেখতে পায় ও তার আহার ও যত্ন শুরু করে দেয়। এদিকে কোকিলের ছানাও বেড়ে উঠতে থাকে। অনেক সময় কোকিলের ছানাও কাকের ডিম ফেলে দেয়। কারণ কোকিল সহ যেকোনো পরজীবী পাখিদের ছানার এটা সহজাত প্রবৃত্তি। এতে করে এদের খাদ্যের প্রতিযোগিতা কমে যায় ও কাকের কাছ থেকে অধিক মনোযোগ পায়। আর এদের বৃদ্ধির হার অনেক দ্রুত হওয়ায় এরা কাকের ছানাদের তুলনায় অনেক আগেই উড়তে সক্ষম হয় ও বাসা ছেড়ে উড়ে চলে যায় আর শুরু করে জীবনের নতুন পর্যায়।