মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে অজগর, অ্যানাকোন্ডা কিভাবে এত বড় প্রাণী গিলে খায়? আমরা সবাই জানি সাপের হাত-পা থাকেনা আর একারণে এদের খাওয়ার ধরনটাও হাত-পা ওয়ালা প্রাণীদের মত নয়। আর এ জন্যে খাবার সংগ্রহে সাপেদের বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়।
কিছু সাপ এদের শিকারকে ধরেই সঙ্গে সঙ্গে বিষ ঢেলে দেয়। আবার কিছু সাপ শিকারকে পেঁচিয়ে দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে মেরে ফেলে। যেমনটা বিষহীন সাপ অজগর, অ্যানাকোন্ডা করে থাকে। তবে শিকার মারা শেষে সকল সাপেরই একটা সাধারণ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আর তা হল কিভাবে এখন শিকারটিকে খাওয়া যায়।
পর্যাপ্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অভাবে অজগর, অ্যানাকোন্ডাসহ যেকোনো সাপেরা এদের শিকারকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে পারেনা। তারমানে এরা কখনই শিকারের মাংস ছিঁড়তে সক্ষম নয়। এরা যা করে তা হল গোটা শিকারটিকেই জোর জবরদস্তি করে মুখে পুরে নেয়। তবে এর জন্য সাপের দেহটি বিশেষভাবে অভিযোজিত।
যখন অজগর, অ্যানাকোন্ডা সাপ এর শিকারকে ধরে তখন প্রথমেই কুণ্ডলী পাকিয়ে দম বন্ধ করে শিকারকে হত্যা করে। এরপর শিকারের মাথাটি নিজের মুখে পুরে নেয় আর নিজের লম্বা শরীরটিকে আস্তে আস্তে ঠেলে দিতে থাকে শিকারের দিকে।
প্রায় সব ধরনের সাপই শিকারের মাথা থেকে গিলতে শুরু করে। এতে করে অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো গিলতে সুবিধে হয়। প্রথমে সাপ তার চোয়াল খুলে ও শিকারকে মুখে পুরে নেয়। এরপর চোয়ালটি আস্তে আস্তে প্রসারিত হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে এটি সমগ্র শিকারটিকে গ্রাস করে নেয়। এক্ষেত্রে সাপের চোয়াল ও গলার মাংসপেশি কাজে লাগে। আর অজগর, অ্যানাকোন্ডা সাপের মুখে থাকা ছোট ছোট দাঁত সমূহ এদের শিকারকে পেটের ভেতরে ঠেলে দিতে সহায়তা করে। এদের মুখে অবস্থিত লালারস পুরো শিকারটিকে ভিজিয়ে দেয় যার দরুন এদের তা গিলতে সুবিধে হয়। এ ধরনের খাদ্যগ্রহণ কৌশল কেবল প্রাণিজগতে শুধু সাপেদেরই মধ্যেই দেখা যায়।
কিন্তু এ প্রক্রিয়া কিভাবে চলে? কিভাবেই বা সাপ এর আকৃতির কয়েক গুন বড় শিকারকে অনায়াসেই মুখে পুরে নেয়? আর কেনই বা এদের চোয়াল এত বেশি প্রসারিত হতে পারে? এর জন্য চলুন জেনে নেয়া যাক সাপের এনাটমি।
চোয়ালঃ
অন্যান্য চতুষ্পদ জন্তুদের যেমন শক্তিশালী চোয়াল ও সংযুক্ত ম্যান্ডিবল থাকে যার ফলে এরা কোনো কিছু কামড়ে ছিরে ফেলতে পারে। কিন্তু সাপেদের বেলায় তা ব্যাতিক্রম। এদের সংযুক্ত চোয়াল থাকেনা। যার ফলে এরা কোনো কিছু শক্তভাবে কামড়ে ধরতে পারেনা। এদের রয়েছে সম্প্রসারণশীল চোয়াল।
স্তন্যপায়ী ও সরীসৃপদের মাথার খুলি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে সরীসৃপদের মাথার খুলিতে অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গর্ত (fenestrae) রয়েছে। এই গর্তসমূহ চোয়ালের বড় বড় মাংসপেশিগুলকে আটকে থাকতে ও প্রসারিত হতে সাহায্য করে। পাশাপাশি এরা মাথার খুলিকেও ওজনে হাল্কা রাখে।
টিকটিকি জাতীয় প্রাণীদের বেলায় দেখা যায় এদের জুগাল বোন অনুপস্থিত থাকে যার ফলে এদের কোয়াড্রেট হাড় মুক্ত থাকে এবং এতে করে এদের চোয়াল বড় করে প্রসারিত হতে পারে। এরাও বেশ বড় আকৃতির খাদ্য গিলে নিতে পারে। আর সাপেদের ক্ষেত্রে জুগাল ও আপার টেম্পোরাল বোন একেবারেই অনুপস্থিত। আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে এদের ম্যান্ডিবলগুলো একে অপরের সাথে সংযুক্ত থাকেনা। আর সাপ এগুলোকে মুক্তভাবে নড়াচড়া করতে সক্ষম। এদের ম্যান্ডিবলগুলো শুধুমাত্র লিগামেন্টের সাহায্যে সংযুক্ত থাকে আর এগুলো বেশ ভালো রকম প্রসারিত হতে পারে। আর এর জন্যই মূলত সাপেরা এদের চোয়ালকে ইচ্ছেমত সম্প্রসারণ করতে সক্ষম।
প্রতিটি ম্যান্ডিবলকে সামনে পেছনে করে অজগর, অ্যানাকোন্ডা সাপ এদের শিকারকে মুখে পুরে নেয়। আর আস্তে আস্তে নিজেদের শরীরটিকে ঠেলে দিতে থাকে। এতেকরে শিকারটিও একসময় সাপের পেটে চালান হয়ে যায়।
অন্যান্য সহায়ক গড়নঃ
অজগর, অ্যানাকোন্ডা সহ যেকোনো সাপের অসাধারণ মাথার খুলির গঠনের পাশাপাশি এদের স্টার্নাম ও ঘাড়ের গ্রিডল হাড় অনুপস্থিত। এর ফলে এদের বুকের পাঁজরও সম্প্রসারণশীল হয়ে থাকে ও বিশাল আকৃতির শিকারও অনায়াসে পেটে পুরে ফেলতে পারে।
সাপেদের রয়েছে কেবল একটিমাত্র ফুসফুস। এরফলে বড় শিকার গিলতে এদের মোটেও দমবন্ধ লাগেনা। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় হল সাপেদের ট্রাকিয়া এদের মুখের সামনে অবস্থিত। এর ফলে শিকার গিলে ফেলার সময় এদের শ্বাসপ্রশ্বাসের রাস্তা পরিষ্কার থাকে।
সবশেষে আরেকটি জিনিস অজগর, অ্যানাকোন্ডাসহ যেকোনো সাপের রয়েছে যার জন্য এরা সহজেই বড় শিকার গিলে নিতে পারে আর তা হল এদের ইলাস্টিকের মত অত্যন্ত নমনীয় চামড়া।