কেন তোতাপাখিরা কথা বলতে পারে?


 

পৃথিবীতে যত প্রাণী রয়েছে তাদের মধ্যে কেবল দু'প্রজাতির প্রাণীই কেবল কথা বলতে পারে। যার একটি হল মানুষ আর আরেকটি হল পাখি। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তোতাপাখি, ময়না পাখি,

কিছু প্রজাতির কাক। তবে তোতাপাখি ও ময়না পাখির স্বর পুরপুরি মানুষের মত। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে কেনই বা এসব পাখিই হুবহু মানুষের মত কথা বলতে পারে যেখানে আমাদের নিকটাত্মীয় অন্যান্য প্রাইমেট প্রজাতিরাই যেমন বাঁদর,গরিলা, শিম্পাঞ্জিরা কথা বলতে পারেনা।

তোতাপাখিরা স্বর শিখে নিতে পারে যার তরথ তারা শব্দ শুনে সেটি উপলদ্ধি করার চেষ্টা করে এবং সেটি বার বার অনুকরণ করার চেষ্টা করে। যদিও অন্যান্য প্রজাতির পাখিরাও কম বেশি শব্দ অনুকরণ করতে সক্ষম তবে এক্ষেত্রে তোতাপাখিরা সবচেয়ে দক্ষ। 

 

 

ডিউক ইউনিভারসিটির নিউরোসায়েন্টিস্ট এবং ভোকাল লার্নিং বিশেষজ্ঞ এরিক জারভিস সম্প্রতি তাঁর প্লোস ওয়ান বিষয়ক একটি গবেষণা প্রকাশ করেছেন যেখানে তিনি এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। কথা বলতে সক্ষম যেকোনো পাখিরই মস্তিষ্কের একটি অংশ রয়েছে যেটি শুধুমাত্র কথা বলা অনুকরণ করার জন্যই নিযুক্ত। এ অংশটিকে বলা হয় "সং সিস্টেম"। কিন্তু তোতাপাখির ক্ষেত্রে এই "সং সিস্টেম" এ রয়েছে দুটি স্তর। যার একটি হল আভ্যন্তরীণ "কোর" যা প্রায় সকল ভোকাল লার্নার পাখিদেরই রয়েছে আর অপরটি হল বাহ্যিক "শেল" যেটি কেবল তোতাপাখিদেরই রয়েছে। জারভিস মনে করেন যে সম্পরতি আবিষ্কৃত এই "শেল" টিই তোতাপাখিকে হুবহু মানুষের কথা অনুকরণে দক্ষ করে তোলে। যদিও আদৌ জানা যায়নি আসলে কিভাবে এই "শেল"টি কাজ করে। 

কিন্তু তাই বলে কেনই বা এরা মানুষের কথাই অনুকরণ করে? এর উত্তর হল "পিয়ার প্রেশার"। এটি প্রকাশিত হয়েছে যে তোতাপাখি এর স্বভাবতই চেষ্টা করে অন্যান্য তোতাপাখি কিংবা মানুষের সাথে খাপ খাওয়াতে।  

 


 

রিসার্চ এসোসিয়েট ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ট-টাইম লেকচারার আইরেন পিপারবারগ বলেন যে ,বন্য পরিবেশে তোতাপাখিরা এদের স্বরের পরাক্রম প্রদর্শন করিয়ে এদের ঝাঁকের অন্যান্য সদস্যদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ ভাব বিনিময় করে থাকে। পিপারবারগ তাঁর অ্যালেক্স নামক আফ্রিকান ধূসর বর্ণের তোতাপাখির বুধিমত্তার রহস্যভেদ করার জন্য বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন। অ্যালেক্স নামক তোতাপাখিটি তাঁর ল্যাবে প্রায় ৩০ বছরের মত ছিল। যদিও পাখিটি ২০০৭ সালে মারা যায়। 

তোতাপাখিরা শিখতে ও বিভিন্ন ধরনের ভাষা ব্যবহার করতেও সক্ষম। কোস্টারিকার হলদে ঘাড়ের আমাজন তোতাপাখির রয়েছে আঞ্চলিক উপভাষা ব্যবহার করার ক্ষমতা। আর যদি তাদের এলাকা পরিবর্তন করা হয় তবে এরা সেখানকার আঞ্চলিক স্বরও অনুকরণ করে ফেলে। নিউ মেক্সিকো স্টেট ইউনিভারসিটির  তোতাপাখির কণ্ঠস্বর নিয়ে অধ্যয়ন করেন এমনি একজন গবেষক টিম রাইট এ বিষয়টি তাঁর গবেষণায় খুঁজে পেয়েছেন।

সুতরাং একটি তোতাপাখিকে মানুষের বাসায় রাখলেই এটি এর পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির সাথে নিজেকে খাপ  খাওয়ানর জন্য মানুষকেই তাঁর ঝাঁকের সদস্য মনে করতে শুরু করবে এবং মানুষের কণ্ঠস্বর নকল করবে।

পোষা তোতাপাখির রয়েছে ভাষা শেখার জন্য প্রয়োজনীয় সময়, উৎসাহ এবং মানসিক সক্ষমতা সবকিছুই। অপরদিকে বুনো তোতাপাখিরা কথা বলা শিখতে মানুষের সান্নিধ্য পায়না। তাই তারা কথা বলতেও পারেনা। বুনো পরিবেশে তোতাপাখিরা একে অপরের ওপর নির্ভর করে কি শিখতে হবে তাঁর জন্য। কিন্তু মানুষের সাথে থাকলে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তারা মানুষের স্বর নকল করে থাকে। 

তবুও প্রশ্ন থেকেই যায় যে আসলেই কি এই পাখিগুলো জানে তারা কি বলছে? তোতাপাখির ক্ষেত্রে কথা বলা একটি অনুষঙ্গ হতে পারে কিন্তু এর কোনো জটিল অর্থ নেই। তার মানে এরা কি বলছে সে সম্পর্কে এদের কোনো ধারণা থাকে না। এরা শুধুমাত্র অনুকরণই করতে পারে। যেমন মালিক ঘরে ঢুকলে যখন তোতাপাখি বলে "হ্যালো ! কেমন আছ?" তখন বুঝতে হবে যে তোতাপাখি আপনার ভাল থাকা বা মন্দ থাকার ব্যাপারে মোটেও চিন্তিত নয়। সে শুধু তাই বলছে যা তাকে তার মালিক শিখিয়েছে। আর এটা মালিক ছাড়াও যে কোনো ব্যক্তি ঘরে ঢুকলেই সে বলবে। তোতাপাখির কাছে "হ্যালো ! কেমন আছ?" অর্থ অনেকটা এরকম: "ওহ! কেউ ঘরে ঢুকেছে"। তোতাপাখিরা অবশ্য মানুষের আনন্দ, রাগ, উত্তেজনা ইত্যাদি অনুভূতিও অনুকরণ করে কথা বলতে পারে। 

 


 

পিপারবার্গ পিএইচডি সম্পূর্ণ করার পর তাঁর তোতাপাখিকে কঠোর প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। পাখিটি শুনত আর দেখত যে গবেষকরা তোতাপাখিটির পছন্দের বিভিন্ন বস্তু শনাক্ত ও সেগুলো একে অপরের সাথে বিনিময় করতেন। তিনি বলেন "তোতাপাখিদের যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ দিলে তারা এটিও বুঝতে পারে যে তারা কি বলছে।" 

জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে অ্যালেক্স প্রায় ৫০ টির মত পৃথক বস্তু, সাতটি রঙ ও ছয়টি আকৃতি  শনাক্ত করতে শিখে। সে এক থেকে আট পর্যন্ত গণনা করতেও পারত। সে সাথে সাথে দেখেই বলতে পারত যে কার কাছে কয়টি পপসিকেল রয়েছে ও কতগুলো কাঠ ট্রের মধ্যে রয়েছে। সে দুটি বস্তু এক না ভিন্ন এবং বড় কিংবা ছোট দেখেই বলে দিত। 

তবে আপাত দৃষ্টিতে তোতাপাখিকে বেশ প্রতিভাধর বলে মনে হলেও মনে রাখতে হবে যে অন্যান্য অনেক প্রাণীই  বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করে যোগাযোগ ও খাদ্য অনুসন্ধানের জন্য। হোক সেটি কথা বলতে পারুক কিংবা নাই পারুক। এটি যেকোনো প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। তবে আমরা শুধু তোতাপাখিকেই বেশি আদর করি কারণ এটাই যে এরা কথা বললে আমরা বুঝতে পারি।

ইউটিউবে দেখুনঃ