নীলগাই শুনলেই চট করে মনে ভাসে নীল চামড়ার এক গরু বা ষাঁড়ের চিত্র। অন্তত নাম শুনে তাই মনে হতে পারে। তবে নীলগাইয়ের নামে 'গাই' শব্দটি যুক্ত থাকলেও এরা আদতে কোনো গরু বা গরুজাতীয় প্রাণী নয়।
নীলগাই (Boselaphus tragoamelus) যেটি হিন্দিতে 'নীলগাও' নামেও পরিচিত মূলত এক প্রজাতির হরিণ এবং এটি মধ্য ও উত্তর ভারত এবং বাংলাদেশে সর্বাধিক দেখা বন্য প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম। এটি নেপালের কিছু অংশেও দৃশ্যমান। পূর্ণবয়স্ক পুরুষেরা দেখতে অনেকটা ষাঁড়ের মত এবং এরা ব্লু বুলস নামেও পরিচিত। নীলগাই এশিয়ার সর্ববৃহৎ হরিণ।
নীলগাই উচ্চতায় প্রায় ১.২-১.৫ (৪-৫ ফিট) মিটার ও দৈর্ঘ্যে প্রায় ১.৮-২ (৬-৬.৬ ফিট) মিটার অবধি হয়ে থাকে। লেজের দৈর্ঘ্য ৪০-৪৫ সেন্টিমিটার। পূর্ণবয়স্ক নীলগাই ওজনে প্রায় ১২০-২৪০ কেজি হয়ে থাকে।
নীলগাইয়ের বাছুর জন্মের পরপরই সাধারণত ওজনে ১৩.৬-১৫.৯ কেজির হয়ে থাকে। এরা ১৮ মাস বয়সেই যৌন পরিপক্কতা অর্জন করে। এদের গড় আয়ুস্কাল হয় ২১ বছর।
![]() |
পুরুষ নীলগাই |
নীলগাইয়ের রয়েছে সরু পা ও বলিষ্ঠ শারীরিক গড়ন। এর দেহটি সামন থেকে পেছনের দিকে ঢালু। এদের লম্বা ও চিকন মাথায় রয়েছে কোণাকৃতির দুটি শিং যেগুলো সোজা ও সামান্য বাঁকানো। এদের ঘাড়ে খাড়া খাড়া কেশর রয়েছে এবং গলার মাঝের অংশে রয়েছে সামান্য লোম।
স্ত্রী নীলগাইদের পশম সাধারণত হলদে বাদামি বর্ণের হয়ে থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে পুরুষদের পশম ধীরে ধীরে কালচে বর্ণ ধারণ করতে থাকে। এদের গালে সাদা ফুটকি দেখা যায় এবং ঠোঁটের কিনারায় সাদা দাগ লক্ষণীয়।
![]() |
স্ত্রী নীলগাই |
নীলগাইদের সাধারণত ৪-২০ সদস্যের দলে বিচরণ করতে দেখা যায়।
নীলগাই মুলত উত্তর ভারতের সমতল ভূমি, উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে শুরু করে দক্ষিণে কর্ণাটক রাজ্য পর্যন্ত দেখা যায়। আবার গির ফরেস্ট থেকে শুরু করে সমগ্র পাকিস্তানের পূর্বাংশে ও রাজস্থানের সীমানা পর্যন্ত এদের বিস্তৃতি রয়েছে। আসামের পশ্চিম অংশ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের পশ্চিমাংশে , নেপালের দক্ষিণ অংশেও এদের দেখা মিলে।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় যে নীলগাই ভারতের দক্ষিণ অংশেও বিদ্যমান ছিল। তবে সেটি বন্য পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
১৯২০ সালে নীলগাই সর্বপ্রথম টেক্সাসের চিড়িয়াখানায় আনা হয় এবং এরপর থেকে এদের টেক্সাসের র্যাঞ্চগুলোতে পাওয়া যায়।
নীলগাই দিবাচারী প্রাণী। এরা ঘাসযুক্ত সমতলভুমিতে বিচরণ করে থাকে। সাধারণত ঘাস, পাতা, ফল ও কুঁড়ি খেয়ে থাকে। বুনো পরিবেশে স্ত্রী ও অপ্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ নীলগাই ১৫ সদস্যের দল গঠন করে ঘুরে বেড়ায়। অন্যদিকে পূর্ণবয়স্ক পুরুষ নীলগাই সাধারণত একা থাকতে ভালবাসে এবং এরা একাকী ঘুরে বেড়ায়। কখনও কখনও নীলগাইদের গ্রামের আবাদি জমিতেও বিচরণ করতে দেখা যায়।
![]() |
নীলগাইয়ের বাছুর |
ভারতে এদের গরু মনে করে পবিত্র বিবেচনা করা হয়। সেখানে মানুষ বিশ্বাস করে নীলগাই হল গরু তাই তা পবিত্র। এতে করে ভারতে নীলগাই শিকারের হাত থেকে সুরক্ষিত। কিন্তু এককালে বাংলাদেশে মুসলমান সম্প্রদায় ভুল করে এদের গরু মনে করে ধরত ও জবাই করে মাংস খেত। আর এভাবেই বাংলাদেশে নীলগাই বিলুপ্ত হয়ে যায়।
কোনো প্রাণী যদি বিপন্ন, বিলুপ্ত কিংবা সংকটাপন্ন হলে তাকে চিহ্নিত করে তালিকা প্রণয়ন করে IUCN (International Union for Conservation of Nature) নামক এক সংস্থা। আর IUCN-এর তালিকায় নীলগাই চিহ্নিত হয়েছে নিম্ন ঝুঁকিপূর্ণ প্রাণী হিসেবে । সোজা কথায়, নীলগাই বিপন্ন প্রাণী নয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে এমন ঝুঁকিতে না থাকা একটি প্রাণীই বাংলাদেশ থেকে এখন বিলুপ্ত। ভারত বিভাজনেরও পূর্বেও শেষবারের মতো এ দেশে নীলগাই দেখা গিয়েছিল। উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, নওগাঁ, জয়পুরহাট ও আশেপাশের জেলাগুলোতে লক্ষ্য করা যেত নীলগাইয়ের অবাধ বিচরণ। তবে বনাঞ্চল উজাড় এবং নির্বিবাদে শিকারের ফলে এদের সংখ্যা দিনে দিনে কমতেই থাকে। এদেশের সর্বশেষ স্থানীয় নীলগাইয়ের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল পঞ্চগড়ে। আর ১৯৪০ সালের পর নীলগাই বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তবে ভাল খবর হচ্ছে, বুনো নীলগাই এখন না থাকলেও বাংলাদেশে রয়েছে দুটি নীলগাই।
বাংলাদেশে ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁও জেলার কুলিক নদীর ধারে একটি নীলগাই ধরা পরে। ধারণা করা হয় নীলগাইটি মূলত ভারত থেকে এদেশে এসেছে। আর সেটি ছিল একটি মাদি নীলগাই। ২০১৯ সালে
নওগাঁ জেলা থেকে আরও একটি নীলগাই ধরা পড়ে। এ নীলগাইটি ছিল পুরুষ। এরপর এই স্ত্রী ও পুরুষ নীলগাইকে রামসাগর জাতীয় উদ্যানে রাখা
হয়েছিল বংশবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ১৬ মার্চ মাদি নীলগাইটি দুর্ঘটনায় মারা গেলে পুরুষ নীলগাইটি একাকী হয়ে পড়ে । আর এতে ব্যাহত হয় নীলগাই বংশবিস্তারের পরিকল্পনা। তবে আবারো ২০২০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে কাঁদায় আটকে পড়া আরেকটি একটি নীলগাই উদ্ধার করা হয়।
এখন এই উদ্ধারকৃত নীলগাইদুটির মধ্যে যৌনমিলনের মাধ্যমে এদেশে পুনরায় নীলগাই সংখ্যা বৃদ্ধির পরিকল্পনা চলছে।